মুজাদ্দিদ আলফে সানি (রহ.) পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। তাঁর ভাষা, চিন্তা ও বৈপ্লবিক কর্মকা-ের ধারণা পাওয়া যাবে তাঁর ‘মাকতুবাত’ পাঠ করলে। উপমহাদেশের মুসলমানদের উচিত তা পাঠ করা। তাঁর মাকতুবাত পাঠ করে বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছে। আল্লামা ইকবাল যথার্থই বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের অতন্দ্র প্রহরী। আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে তাঁকে দান করেছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সামনে যিনি মাথানত করেননি, বরং তাঁর আধ্যাত্মিকতার উত্তাপে জাহাঙ্গীরকে উত্তপ্ত করেছেন।’
মুজাদ্দিদ আলফে সানি (রহ.) ‘বিদআত হাসানাহ’-কে প্রত্যাখ্যান করতেন। আমি আপনাদের সামনে তাঁর একটি মাকতুবাতের অংশ তুলে ধরছি, যা থেকে তাঁর প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা এবং নিষ্কলুষ তাওহিদের প্রতি তাঁর আত্মমর্যাদা ও অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এমন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন লেখা ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়িম জাওজির রচনাভা-ারেও পাওয়া যায় না।
শায়খ আবদুল করিম ইয়ুমনি নামের এক ব্যক্তি ছিল। যে বলত, (আল্লাহ ক্ষমা করুন!) আল্লাহ ‘কুল্লিয়াত’ তথা সামগ্রিক জ্ঞান রাখেন, তবে ‘জুঝিয়্যাত’ তথা আনুষঙ্গিক বিষয়ে জ্ঞান রাখেন না। কোনো একজন মুজাদ্দিদ আলফে সানি (রহ.)-কে বিষয়টি অবগত করেন। এটা ছিল উম্মতের সর্বসম্মতিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাসের পরিপন্থী। ফলে মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) লেখেন, ‘মাখদুমান! (যার সেবা করা হয়) এমন কথা শোনার পর আমার ভেতর শুধু ব্যথা জমেনি, বরং অনিচ্ছাকৃতভাবে ক্রোধেরও জন্ম নিয়েছে। এই বক্তব্য যারই হোক—শায়খ আবদুল করিম ইয়ুমনির বা শায়খ মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবির। আমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-ই উত্তম আদর্শ।
মদিনার বিজয়গুলো আমাদেরকে মক্কার বিজয়গুলো থেকে অমুখাপেক্ষী করে দিয়েছে। অর্থাৎ নবীজি (সা.)-এর সুন্নাহ ও হাদিস আমাদের সামনে থাকলে তা মক্কা বিজয় থেকে বিমুখ করে দেয়। আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নুসুস তথা কোরআন ও সুন্নাহ, ফুসুস বা মনগড়া গালগল্প গ্রহণযোগ্য নয়।’
মূলত তিনি তাঁর বক্তব্যে শায়খ মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি ও তাঁর দুটি বইয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। শায়খ মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) ছিলেন একজন সুফি ধারার বিখ্যাত আলেম। তাঁর মাধ্যমে ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ (সর্বেশ্বরবাদী বিশ্বাস) সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। বড় বড় বুজুর্গ ও তরিকতের শায়খরা শুধু ওয়াহদাতুল উজুদের বিশ্বাসকে ধারণ করেননি, বরং তা প্রচারও করেছেন। তাঁরা এ বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন।
শায়খ মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) দুটি বই লেখেন। একটি হলো ‘ফুতুহাতে মাক্কিয়াহ’—এই বইয়ে তিনি ওয়াহদাতুল উজুদ মতবাদের সুস্পষ্ট প্রচার করেছেন। অপর বইয়ের নাম ‘ফুসুল হুকুম’।
সম্রাট আকবর যখন মসনদে আরোহণ করেন তখন ইসলাম আগমনের এক হাজার বছর পূর্ণ হচ্ছিল। ইরানিদের একটি গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তারা জগদ্বাসীকে এই বার্তা দিতে চাইছিল যে, পৃথিবীতে ইসলামের সময়কাল শেষ হয়ে গেছে। তারা আকবরের মাথায় এই বিষয়টি ঢুকিয়ে দিয়েছিল—প্রতি ধর্মের সময়কাল এক হাজার বছর। ইসলামের পূর্ববর্তী ধর্মগুলো এক হাজার বছর পর অস্তিত্ব হারিয়েছে। ইসলামের সময়কালও শেষ হয়েছে।
ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের বুদ্ধিমত্তার কারণে বুঝতে পেরেছিল, তাদের এই চিন্তা গ্রহণ করা এবং তা কার্যকর করার জন্য এমন একজন লেখাপড়া ও জানা-শোনার পরিমাণ খুবই কম। সে হিসেবে তারা সম্রাট আকবরকে নির্বাচন করে এবং তারা তাকে ধর্মচ্যূত করতে সক্ষম হয়। আকবর হিন্দু প-িত ও আলেমদের ডেকে বিতর্ক করাতেন এবং ধর্মহীনতাকে প্রাধান্য দিতেন। এমন সংকটময় সময়ে মুজাদ্দিদ (রহ.) ও তাঁর পরিবার এই প্রেক্ষাপটে উপস্থিত হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ দ্বিন ও ঈমানকে রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ফলে দেশ ও জাতির সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল তা দূর হলো। আজ আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম রক্ষা পেয়েছে মুজাদ্দিদ আলফে সানি (রহ.)-এর বদৌলতে। তাঁর সংগ্রামের ফলে ইসলাম আমাদের পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় পৌঁছেছে। যদিও ইসলামের ওপর বহু অবিচার হয়েছে। আল হামদুলিল্লাহ! ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা বহু আরব দেশের তুলনায় ইসলামের অনুসরণ, নবীজি (সা.)-এর আনুগত্য, স্বজাতির প্রতি ভালোবাসায় এগিয়ে। মাওলানা হাবিবুর রহমান খান শিরওয়ানি (রহ.) বলেন, সাধারণত রাজা-বাদশাহরা ধর্মবিরোধী হলে তাঁদের উত্তরসূরিরা আরো বেশি ধর্মবিরোধী হয়। কিন্তু আকবরের পর তাঁর উত্তরসূরিদের ভেতর ধর্মের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরকে ষষ্ঠ খলিফায়ে রাশেদ বলা হয়। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.)-এর পর আল্লাহভীতি, ইবাদত-বন্দেগি, সুন্নতের অনুসরণ ও আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে সম্রাট আওরঙ্গজেব অগ্রগামী। আর এটা সম্ভব হয়েছে মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.), তাঁর পরিবার ও শিষ্যদের প্রচেষ্টার ফলে। মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.)-এর চেষ্টা ও সংগ্রামের প্রধান বৈশিষ্ট্য চারটি। তা হলো: ১. ইসলামের বিশ্বাস : সবার আগে মানুষের আকিদা ও বিশ্বাস ঠিক করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে তাবে-তাবেয়িন পর্যন্ত সবার কর্মপদ্ধতি এটাই ছিল।
২. দ্বিনের বোধ তৈরি : ঈমান ঠিক হওয়ার পর তিনি মুসলমানের ভেতর দ্বিনের বোধ ও মূল্যবোধ তৈরির চেষ্টা করেছেন। আলেমদেরও এটাই দায়িত্ব যে তাঁরা নিজেদের সাধ্যমতো মানুষের ভেতর দ্বিনি মূল্যবোধ তৈরির কাজ করবেন।
৩. দ্বিনের প্রচার ও প্রসার : ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে দ্বিনের জোরাল প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছিলেন মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.)।
৪. দ্বিন রক্ষায় আত্মোৎসর্গ করা : মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) দ্বিন রক্ষায় নিজেকে যেমন উৎসর্গ করেছিলেন, তেমনি মানুষের ভেতর দ্বিনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মানসিকতা তৈরি করেছিলেন। (তামিরে হায়াত থেকে আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাষান্তর)