আমাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণের মুখ্য উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি করা। ইবাদত করতে শক্তি, সামর্থ্যরে প্রয়োজন হয়। আর তার জন্য খাবারের প্রয়োজন। সে জন্য চাই হালাল উপার্জন। হালাল উপার্জনের উত্তম মাধ্যম ব্যবসায়। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, নবীজীকে উত্তম উপার্জন স¤পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, স্বীয় হাতে উপার্জিত স¤পদ ও সৎ ব্যবসায় উপার্জনকৃত স¤পদ। (আত-তারগিব-১২৯০) নবী, সাহাবি, তাবে-তাবেইন, ইমাম-মুজতাহিদ সবাই ব্যবসার মাধ্যমে জীবনোপকরণ উপার্জন করেছেন। গুরুত্ব বুঝে আমাদেরও ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়া উচিত।
সম্পদের প্রয়োজনীয়তা : সম্পদের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কমবেশি সব যুগেই সম্পদের প্রয়োজনীয়তা ছিল। হাল জামানায় স¤পদের প্রয়োজনীয়তা একটু বেশিই। কারণ, সম্পদের আধিক্য যেমন ব্যক্তির বিপথগামী হওয়ার মাধ্যম, তেমনি চলার মতো যৎসামান্য সম্পদ ব্যতীত ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকাও দুষ্কর। তাই, ঈমানের উপর অবিচলতার জন্য হলেও সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সুফিয়ান সাওরি রহ: বলেন, বর্তমান সময়ে সম্পদ মোমিনের হাতিয়ার। অন্যত্র তিনি বলেছেন, অতীতকালে সমপদকে অপছন্দ করা হতো। কিন্তু বর্তমান যুগে তা মোমিনের ঢাল। (ইসলাহিল-মাল-৭৯) আর ব্যবসায় সম্পদ উপার্জনের হালাল মাধ্যম।
ব্যবসায় সম্পর্কে ইমাম আহমাদকে জিজ্ঞাসা : ইমাম জাসসাসি রহ: বলেন, আমি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ:-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার কাছে চারটি দিরহাম (টাকা) আছে। যার প্রথমটি গম ব্যবসায় থেকে উপার্জিত। দ্বিতীয়টি ভাইয়ের কাছ থেকে হাদিয়া হিসাবে পাওয়া। তৃতীয়টি শিক্ষাদানের বদলায় পাওয়া আর চতুর্থটি বাগদাদের আত্মসাৎকৃত। এর মধ্যে আপনার কাছে সর্বাধিক প্রিয় টাকা কোনটি? উত্তরে তিনি বললেন, আমার কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হলো ব্যবসার টাকা। অতঃপর ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া টাকা। শিক্ষাদানের বদলায় টাকা নেয়ার প্রয়োজন হলে নেয়া যেতে পারে। আর আত্মসাৎকৃত টাকার বিধান তো তুমি জানোই। (তারিখুল বাগদাদ-১ : ২৯৪) ব্যবসার টাকা সর্বাধিক হালাল, শর্ত হচ্ছে ব্যবসায় ইসলাম নির্ধারিত নিয়মে করতে হবে।
ব্যবসার মাধ্যমে অল্প সম্পদে স্থায়িত্ব আসে : সম্পদের সঠিক ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিকল্পিত খাতে সম্পদের ব্যবহার সম্পদের স্থায়িত্ব ও বৃদ্ধি করণে সাহায্য করে আর অপরিকল্পিত ব্যবহার সম্পদের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে। তাই অল্প স¤পদকে যথাযথভাবে ব্যবসায় খাটালে তা অবশিষ্ট থাকে, লাভের মাধ্যমে বহু অংশে বৃদ্ধি পায়। আবার পরিচর্যাহীন অধিক সম্পদ অল্প দিনেই শেষ হয়। যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা না হয় তাহলে অধিক হওয়া সত্ত্বেও তা ধ্বংস হয়। লোকমুখে প্রচলিত আছে, বসে খেলে কারুনের সম্পদও শেষ হয়। আবু আব্দুল্লাহ রহ: বলেছেন, অল্প-সম্পদ সঠিক ব্যবহারে বাকি থাকে। আর বেঠিক-ব্যবহারে অধিক স¤পদও নষ্ট হয়। (আল-হাচ্ছু আলা-তেজারা-১৭) তাই, সম্পদকে ব্যবসায় খাটানো উচিত। ব্যবসার কারণে জান্নাত : মানুষ ব্যবসায় নিজের লাভের জন্য করে থাকে। কিন্তু এই ব্যবসায়ই যদি কেউ ইসলামী বিধি মোতাবেক সততার সাথে পরিচালনা করে। কাউকে ধোঁকা না দেয়। মিথ্যা কথা ও মিথ্যা আশ্বাস না দেয়। পরিচ্ছন্নভাবে ব্যবসায়িক কার্যাবলি আঞ্জাম দেয়। তাহলে এমন ব্যবসায় দুনিয়ার পাশাপাশি কিয়ামতেও ব্যবসায়ীর উপকারে আসবে। সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, সত্যবাদী ব্যবসায়ী জান্নাতের কোনো দরজায় বাধাপ্রাপ্ত হবে না। (কাঞ্জুল উম্মাল-৯২১৯) সে জান্নাতের যেকোনো দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। কোথাও তাকে বাধা দেয়া হবে না। এর থেকে উত্তম বিষয় কিছু হতে পারে না।
নবীদের সাথে জান্নাতে থাকার সৌভাগ্য : আমরা দুনিয়াতে বাসাবাড়ি করার ক্ষেত্রে উত্তম ও ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিবেশী খুঁজি। ভালো ব্যক্তিদের সাথে ওঠা-বসা করতে উদগ্রীব হয়ে থাকি এবং এটিকে নিজের জন্য গর্বের বিষয় মনে করি। জান্নাতের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হবেন নবীরা। আর নবী-রাসূলদের প্রতিবেশী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে সে সব ব্যবসায়ী যারা সততা ও নিষ্ঠার সাথে ব্যবসায় করবে। যারা ব্যবসায় করবে মানুষের উপকারের নিয়তে। বিশ্বাস ও আমানতদারির সাথে। মানুষের আস্থা বজায় রেখে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং সেখানে প্রথম শ্রেণীর জান্নাতিদের সাথে থাকবে। নবীজী সা: বলেছেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার মুসলিম ব্যবসায়ী জান্নাতে নবী, সিদ্দিক (সত্যবাদী) এবং শহীদদের সাথে থাকবে।’ (তিরমিজি-১২০৯)
ব্যবসায় দারিদ্র্যের অভিশাপমুক্তি : ব্যবসায় ব্যক্তিকে মুখাপেক্ষিতার অভিশাপ মুক্ত করে। দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দেয়। আর্থিক সচ্ছলতা ও স্বাবলম্বিতা দান করে। ব্যক্তিকে আত্মনির্ভর করে। তাই, আমাদের ব্যবসায় জড়ানো উচিত। জগদ্বিখ্যাত অনেক বড় বড় আলেম ব্যবসায় করেছেন। এমনি একজন জগদ্বিখ্যাত বিদগ্ধ আলেম সারিই ইবনে ইয়াহইয়া রহ:। তিনি সামুদ্রিক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। একজন ব্যক্তি আশ্চর্য হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দুনিয়া উপার্জনের জন্য আপনি সমুদ্রযাত্রা করবেন? তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, আমি তোমার মতো মানুষের কাছে থেকে অমুখাপেক্ষিতাকে পছন্দ করি। ফজল ইবনে জিয়াদ রহ: বলেন, আমি আবু আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, তিনি বাজারে যাওয়ার (ব্যবসার) আদেশ করছেন এবং বলছেন, ‘মানুষের থেকে অমুখাপেক্ষিতা কতই না উত্তম’। (আল-হাচ্ছু আলা-তেজারা-১৭)
ইবাদতের পরই হালাল রিজিক অন্বেষণ : ফরজ ইবাদতের পর ব্যক্তির জন্য অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো হালাল রিজিক অন্বেষণ করা। হালাল রিজিক উপার্জন করা। যেমনটি সূরা জুমুয়ায় এসেছে, অতঃপর নামাজ শেষ হলে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) অন্বেষণ করো। (১০) আর হালাল রিজিকের বরকতময় মাধ্যম ব্যবসায়। মোজাহিদ রহ.-সহ অন্যান্য মুফাসসিরিনের মতে, আয়াতে অনুগ্রহের অর্থ হলো রিজিক। আমরা নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় বলি, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন-ফাদলিক। এই দোয়ায় আমরা বলি, হে আল্লাহ আমি আপনার অনুগ্রহ-রিজিক চাচ্ছি। (মুসলিম-৭১৩) রিজিক প্রাপ্তিতে ব্যবসার জুড়ি নেই।
নব্বই শতাংশ রিজিক ব্যবসায় : ব্যবসায় হালাল রিজিকের প্রশস্ত অঙ্গন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা ধারণাতীত বরকত রেখেছেন। নবীজী সা: বলেছেন, রিজিকের ১০ ভাগের ৯ ভাগই রয়েছে ব্যবসায়-বাণিজ্যে। (কাঞ্জুল উম্মাল-৯৩৪২) অর্থাৎ ৯০ ভাগ রিজিক আল্লাহ ব্যবসায় রেখেছেন। ভাবনার বিষয় বটে! মুসলিমরা আজ ব্যবসায় ভুলতে বসেছে। আমাদের ব্যবসায় করা খুবই জরুরি।
মহামানবদের ব্যবসায় সম্পৃক্ততা : পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর প্রিয় বন্ধু নবী মুহাম্মদ সা: নিজেও ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন। ১২ বছর বয়সেই চাচার সাথে প্রথম ব্যবসায়িক সফরে শামিল হয়েছিলেন। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর রা: কোরাইশদের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। খলিফা মনোনীত হওয়ার পরও ব্যবসায় চালিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় কাজের চাপ বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায় বন্ধ করেছিলেন। ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমান রা: জগদ্বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের ইমাম আবু হানিফাসহ ইসলামের প্রায় সব মহামানব ব্যবসায় স¤পৃক্ত ছিলেন। আমাদেরও উচিত হালাল রিজিকের জন্য এবং পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে, সম্মানজনক রিজিকের তালাশে ব্যবসায় করা। লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদরাসা, রংপুর