শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন

আখলাকের চর্চা পরিবারে না থাকার বিপদ

জামান শামস
  • আপডেট সময় বুধবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতে পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশে দ্বীন জানা ও মানা সহজ। ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন ও সমাজ জীবনে দ্বীনের চর্চা করা এবং উত্তম পন্থায় দ্বীন পালন করার পরিবেশ এখানে আছে। সালাত, সাওমসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদত পালনে প্রকাশ্য কোনো বাধা নেই। এটি বাস্তবিক অর্থেই আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নিয়ামত। যদিও মৌলিক ইবাদতের বাইরে ইসলামের পালনীয় আরো কর্তব্য রয়েছে এবং সেগুলো পালনে মতপার্থক্য ও কোথাও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও বিরাজমান।
আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো- পরিবারে ইসলামী মূল্যবোধ, পবিত্রতা ও আখলাকের পরিবেশ নিশ্চিত করা। ইসলামী বেশভূষা ধারণ করেও অনেক পরিবারে ইসলাম চর্চা হয় না এটি বাস্তব। এমন পরিবারের সংখ্যা নগণ্য বলেই আমার বিশ্বাস। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের পরিবারগুলো এমন বৈপরিত্য থেকে ব্যতিক্রম। এটি চরম অপমানজনক, বিব্রতকর ও অসম্মানজনক। দ্বীন জানা ও মানার এই সুযোগ-পরিবেশ পাওয়ার পর আমাদের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত ছিল, একটু ভাবলেই বুঝে আসে। কিন্তু ব্যাপকভাবে অবহেলা আর উদাসীনতায় আমরা কী পরিণতির শিকার, সেটিও স্পষ্ট।
নিশ্চয় একদিন আমাদের আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। তাঁর কাছে জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব আমাদের দিতে হবে। কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এরপর সেদিন তোমাদেরকে নিয়ামতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে (যে, তোমরা কি হক আদায় করেছ?)’ (সূরা তাকাছুর-৮)।
পরিবার একটি পবিত্র সংস্থা। মানবশিশুর সর্বপ্রথম ও সর্বোত্তম শিক্ষালয়। মা-বাবাই সন্তানের প্রথম আদর্শ, শিক্ষক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগেও যেমন নবজাতকের জন্য মায়ের দুধের বিকল্প খাবার কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, তেমনি সুনাগরিক তৈরিতে পরিবারের বিকল্প কোনো প্রতিষ্ঠান আজো গড়ে ওঠেনি। তাই ইসলাম পারিবারিক পরিবেশে দ্বীন চর্চায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা তাহরিমের ৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকুল, আল্লাহ তাদের যে নির্দেশ দিয়েছেন তারা সে ব্যাপারে তার অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদের আদেশ করা হয়।’
মানবশিশুর সবচেয়ে কার্যকর এ বিদ্যাপীঠে শিশুকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু আধুনিকতার নামে সেই পারিবারিক শিক্ষায় যেমন উপেক্ষিত বাংলা ভাষা, তেমনি উপেক্ষিত ইসলামও। মা-বাবা, ভাইবোন সবাই একসাথে দেখছে হিন্দি ফিল্ম। শিশু তালিম নিচ্ছে ছুরি দিয়ে অন্যকে হত্যা করার বিদ্যা। একটু বড় হতে না হতেই প্রাইভেট, কোচিং টিউটরসহ কত কী! ফজরের নামাজে বাবার হাত ধরে জামাতে শামিল হওয়ার দৃশ্য হারিয়ে গেছে কথিত আধুনিকতার অতল গহ্বরে। বাড়ছে জিপিএ-৫-সহ পাসের হার, কমছে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা। ফলে পারলৌকিক জীবনের শাস্তি তো আছেই; পার্থিব জীবনেও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে দুঃসহ যন্ত্রণা। সন্তানের মন-মনন তৈরিতে মা-বাবার ভূমিকা সব থেকে বেশি। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক সন্তানই ইসলামী ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। এরপর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, নাসারা অথবা অগ্নিপূজক বানিয়ে ফেলে…’ (বুখারি-১৩৫৮, মুসলিম-২৬৫৮, আহমাদ-৭১৮১)
কিয়ামত দিবসে, সেই ভয়াবহ সময়ে আল্লাহ আমাদের জবান বন্ধ করে দেবেন। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সাক্ষীর জন্য উপস্থিত করবেন। অণু পরিমাণ অপরাধও সেদিন গোপন থাকবে না অথচ কি আশ্চর্য যে, আজ প্রকাশ্য বড় গুনাহের কাজকেও মানুষ থোড়াই পরোয়া করে! কিরামান কাতেবিন বা সম্মানিত ফেরেশতাদ্বয়ের লিখিত রিপোর্টের পর হাত-পায়ের সাক্ষ্য সেটিকে আরো সত্যনিষ্ঠ করবে।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘ আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেবো, তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’ (সূরা ইয়াসিন-৬৫)
ভালো-মন্দ, কোন কাজে আল্লাহর নাফরমানি কিশোর-কিশোরীরা বুঝতে অক্ষম। তাই মা-বাবাকে শৈশব থেকেই তাদের প্রতি বিশেষ যতœশীল হতে হবে, তাদের মনে শৈশব থেকেই গুনাহ-পাপাচারের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। সন্তানকে কখনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাপাচারের প্রতি উৎসাহিত করা যাবে না। কারণ, পৃথিবীতে কোনো মা-বাবা সন্তানকে ইসলামে নিষিদ্ধ কাজের বিষয়ে নিষেধ না করলে এবং এর ক্ষতির দিক না বুঝালে তাদেরকে পরকালে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। কারণ, তারা সন্তানের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। আল্লাহ সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক করে বলেন- ‘সেদিন সন্তানরাই আল্লাহর কাছে বিচার ও শাস্তি দাবি করে নিজেরা অব্যাহতি চাইবে।’ দেখুন আয়াতটি- ‘হে আমাদের রব, আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ আজাব দিন এবং তাদেরকে বেশি করে লানত করুন।’ (সূরা আহজাব-৬৮)
সুতরাং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে মা-বাবাকে। পরিবারেই দ্বীন শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। আকাশ, চন্দ্র-সূর্য, বৃষ্টিতে যে মহান শক্তির হাত তা শুনিয়ে সুকৌশলে তিলে তিলে তার কোমল হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালার প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভীতির বীজ বপন করা একান্ত প্রয়োজন। শিশুরা গল্প শুনতে ভালোবাসে। আজগুবি গল্প না বলে সাহাবায়ে কেরাম, ইসলামী মনীষীদের হৃদয়কাড়া গল্প শুনিয়ে ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসা বদ্ধমূল করে দিতে হবে। শোনাতে হবে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সিরাত। অনেক সময় আমরা শিশুদের ভুলাতে, তাদের রাগ থামাতে কিংবা শান্ত করতে বলে থাকি- ‘এ কিনে দেবো, ও কিনে দেবো’ কিন্তু বাস্তবে তা আদৌ করি না। যে ওয়াদা পূরণের ইচ্ছা নেই, তা করা মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। এতে শিশুর মস্তিষ্কে প্রতারণার চিত্র ধারণ করবে।
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা শেখাতে হবে পরিবারেই। বড়কে শ্রদ্ধা, ছোটকে স্নেহ করার মানসিকতা তৈরি করে দিতে হবে পরিবারেই। যে মানুষ যত বড়, সে তত বিনয়ী। শিক্ষা দিতে হবে বিনয়-নম্রতার মহান গুণ। প্রতিবেশী গরিব-দুঃখীদের সাথে মিশতে দিতে হবে। সন্তান যতই ছোট হোক, এমনকি দুধের শিশু হলেও তার সামনে কোনো ধরনের যৌনালাপ ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতে তার মস্তিষ্কে নির্লজ্জের যে ছাপ পড়বে তাতে শয়তানের কুমন্ত্রণায় তা প্রকট হয়ে উঠবে। সামান্য অন্যায়ে বকাঝকা করা অনুচিত। প্রয়োজনে একান্তে বসে শাসন করা যায়। ইসলামী অনুশাসনের প্রতি তাকে আগ্রহী করার শ্রেষ্ঠ সময় এখনই। অশ্লীলতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পরিবারে পর্দার বিধান কঠোরভাবে মেনে সন্তানকে এর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। মা-বাবাকেই প্রথম সময়মতো নামাজ আদায়ের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তানকেও শেখাতে হবে নামাজ। রাসূলুল্লাহ সা: সন্তানকে শৈশবেই নামাজের আদেশ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের সন্তানের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখনই তাদের নামাজের আদেশ দাও।’ (আবু দাউদ)
তবে মা-বাবা যদি সন্তানকে পাপাচার ও গুনাহ থেকে বিরত রাখেন এবং তাদেরকে সঠিক ইসলামী শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং মা-বাবা পৃথিবীতে কখনো সন্তানকে পাপাচারের প্রতি উৎসাহ না দিয়ে থাকেন কিন্তু এরপরও সন্তান পাপাচারে লিপ্ত হয়, তাহলে সন্তানের এমন কাজের জন্য মা-বাবাকে কবরে শাস্তি ভোগ করতে হবে না।
আর সন্তান যদি মা-বাবার দেখানো পথ অনুযায়ী নেক আমল করে তাহলে মা-বাবার কবরে এর সাওয়াব পৌঁছাবে। এ বিষয়ে হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি আমল বন্ধ হয় না- ১. সদকায়ে জারিয়া; ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ও ৩. এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম-৪৩১০) আল্লাহ আমাদের সহিহ বুঝ দিন। আমিন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com