সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৮ অপরাহ্ন

মাসব্যাপী সোনারগাঁওয়ে লোকজ ও কারুশিল্প মেলায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়

মাসুম মাহমুদ (সোনারগাঁও) নারায়ণগঞ্জ
  • আপডেট সময় শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব জমে উঠেছে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারী) সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন আয়োজিত লোকজ উৎসব। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী আসছেন এ মেলায়। ছুটির দিন ছাড়াও প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা আসছেন। বাংলার লোক ও কারুশিল্পের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিপণন ও পুনরুজ্জীবনের লক্ষে সোনারগাঁয়ের বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কতৃপক্ষ মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের আয়োজন করেছে। উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো কর্মরত কারুশিল্পীদের বিভিন্ন কারুশিল্প প্রদর্শনী। মেলায় আসা উৎসুক দর্শনার্থীদের প্রচ- ভিড় লক্ষ্য করা গেছে এতে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কারুশিল্পীরা এ উৎসব চত্বরে তাদের কারুপণ্য তৈরি ও বিক্রি করছেন।সাধারণ মানুষ এ কারুপণ্য তৈরির কলাকৌশল দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থীর ঢল ছিল চোখে পড়ার মতো। বিপুল দর্শনার্থীদের চাপে ফাউন্ডেশনের সামনের সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে দর্শনার্থীসহ স্থানীয়রা বেশ ভোগান্তিতে পড়ে। গজারিয়া থেকে আগত দর্শনার্থী আলেয়া জানান, শুক্রবার ছুটির দিন থাকার সুবাদে এসেছি লোকজ উৎসবে। হাতের তৈরী কাঠের, তাঁতের বিভিন্ন পন্য ক্রয় করেছেন। লোকজ মেলায় এসে তারা মুগ্ধ হয়েছেন বিভিন্ন কারু পন্য দেখে এবং ক্রয়ও করেছেন। গাজীপুর থেকে আগত দর্শনার্থী সেলিম জানান, তিনি সরকারি চাকরি করেন। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়াতে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে এসেছেন লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে।দেশীয় হাতের তৈরী পন্যও ক্রয় করেছেন তিনি। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক একেএম আজাদ সরকার জানান, হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই মাসব্যাপী এ মেলার আয়োজন। উল্লেখ্য, গত ১৬ জানুয়ারি শুরু হওয়া এ উৎসব শেষ হবে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উৎসব প্রাঙ্গণ খোলা থাকবে। উৎসবে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা। এ বছর মৌলভীবাজার ও ঝালকাঠীর শীতল পাটি, মাগুরার শোলাশিল্প, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি ও মাটির পুতুল, রংপুরের শতরঞ্জি, সোনারগাঁ, টাঙ্গাইল ও ঠাকুরগাঁয়ের বাঁশ বেতের কারুশিল্প, ঐতিহ্যবাহী জামদানি, কাঠের চিত্রিত হাতি-ঘোড়া-পুতুল, বন্দরের রিকশা পেইন্টিং, কুমিল্লার, তামা-কাঁসা-পিতলের কারুশিল্প, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কারুশিল্প, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা পুতুল, বগুড়ার লোকজ খেলনা ও কুমিল্লার লোকজ বাদ্যযন্ত্রের শিল্পীসহ মোট ১৭ জেলার কারুশিল্পীরা মেলায় অংশ নেবেন। প্রতিবারের মতো এবারও মেলায় বিশেষ কর্মসূচি হিসেবে কারুশিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য ১৫টি স্টল দেওয়া হয়েছে। মাসব্যাপী লোকজ উৎসব ২০২৪ এর প্রতিদিনের সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানমালায় লোকজ মঞ্চে পালাক্রমে বাউলগান, পালাগান, ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালী গান, জারি-সারি গান, হাসন রাজার গান, শাহ আব্দুল করিমের গান, লালন সঙ্গীত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গ্রামীণ খেলা, লাঠিখেলা, ঘুড়ি উড়ানো, চর্যাগান, লোকগল্প বলা ইত্যাদি অনুষ্ঠান পরিবেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আসছেন এই উৎসবে। ঘুরে ঘুরে মেলার বিভিন্ন স্টল থেকে কেনাকাটা করছেন আগত পর্যটকরাও। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন থাকার সুবাদে অনেকেই এসেছেন লোকজ উৎসবে। তারাও হাতের তৈরী কাঠের, তাঁতের বিভিন্ন পন্য ক্রয় করেছেন লোকজ মেলায় এসে। তারা মুগ্ধ হয়েছেন বিভিন্ন কারু পন্য দেখে। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আয়োজনে নাচ, গান, অভিনয় ও চিত্রাঙ্কন। মেলা চলাকালীন দেশী বিদেশী পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে ফাউন্ডেশন চত্বর। তবে ছুটির দিনে পর্যটক বেশি হয়। মেলার অন্যতম আকর্ষন দেশের লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে বায়োস্কোপ। কাঠের বাক্সে করে আর্ট কাগজের মাধ্যমে লোকজীবন চিত্র প্রদর্শণ ও বিনোদনের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী মাধ্যম এটি। ইতিহাস ঐতিহ্যের পাতায় গ্রামীণ এই বায়োস্কোপের বেশ প্রশংসা থাকলেও কালের বিবর্তনে শুধুমাত্র পৃষ্ঠপোষকতার অভাব থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ বিনোদনের অন্যতম এই মাধ্যম। বাংলাদেশ লোককারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতি বছর মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব করে থাকে লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ ঐতিহ্যকে পুণরুদ্ধার, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শণের জন্য। কিন্তু পৃষ্ঠপোশকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এই লোকজ ঐতিহ্য বায়োস্কোপ। এক হাতে চড়কা ঘুরাচ্ছেন আর হাতে ডুগডুগি বাজিয়ে ছন্দের তালে তালে বায়োস্কোপের মালিক ভাঙা ভাঙা গলায় গাইছেন ‘এইবারেতে দেখেন ভালো, দেশ স্বাধীনের যুদ্ধ এলো, ভীষন যুদ্ধ বাইদ্ধা গেছে, দেখতে কতো বাহার আছে।বায়োস্কোপের মালিক আব্দুল জলিল মন্ডলের সাথে কথা বল জানা গেছে, তার বাড়ি রাজশাহী জেলার বাগমারা থানার চাইসারা গ্রামে। দাদার আমল থেকে ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ প্রদর্শন করছেন তারা। সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে তৈরি করা হয় বায়োস্কোপ প্রদর্শণের চিত্র। বিনোদনের মাধ্যমে আয় করে প্রায় ৪০ বছর যাবত সংসার চালাচ্ছেন তিনি। স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। আগে সব বয়সের মানুষ দেখতো এই বায়োস্কোপ। এখন আর আগের মতো দেখেনা। এখন শুধু বাচ্চারা একটু দেখে। শুধুমাত্র বাপ দাদার স্মৃতির জন্যই ঐতিহ্যবাহী এই বায়োস্কোপ ধরে রেখেছেন তিনি। জনপ্রতি ১৫-২০ টাকা করে মেলায় সারাদিন দেখিয়ে গড় হিসেবে ৫-৬শ’ টাকা রোজগার হয়। তা থেকেই খাওয়া থাকা ইত্যাদি খরচ বহন করতে হয় তাকে। হতাশা কন্ঠে তিনি বলেন, এই লোকজ উৎসবে আমাকে ডাকা হয়না। খোঁজ খবর নিয়ে আমিই স্যারদের ফোন করি আসার জন্য। বায়োস্কোপ প্রদর্শণীর জন্য ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কোন সম্মানীও দেয়া হয়না। ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালো ধারনা পেতে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা জরুরী। এ ব্যাপারে ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক এ কে এম আবুল কালাম আজাদ সরকার জানান, বায়োস্কোপ আমাদেরই লোকজ ঐতিহ্য। এই বছর বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর জন্য শিল্পি সম্মানী দেয়া না গেলেও ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তাকে যাতায়াত বাবদ কিছু সম্মানী দেয়া হবে এবং আগামী বছর থেকে তাকে শিল্পি সম্মানী দেয়া হবে। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com