ফুলের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ঝিনাইদহ জেলা। ঝিনাইদহ জেলার ফুল চাষীরা বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দুই কোটির ফুল বিক্রির টার্গেট নিয়েছেন। এছাড়া প্রতিবছর বসন্ত বরণ, ভালবাসা দিবস, বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। আর এই চাহিদার সিংহভাগ যোগান দিয়ে থাকে কালীগঞ্জের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা। বাজার ভালো পেলে টার্গেট অনুযায়ী ফুল ও বিক্রি হবে। যে কারণে কালীগঞ্জের ফুল চাষীদের মুখে ফুটেছে হাসি। এখানকার ফুলের চাষের মধ্যে রয়েছে, গোলাপ, জারবেরা, চন্দ্র মল্লিকা, গ্লাডিওলাস,লিলিয়াম,রজনীগন্ধা, গাঁদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল। বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও সামনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দুই দিনে এখানকার ফুল চাষিরা ২ কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি করবেন বলে আশা করছেন।ঝিনাইদহ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফুল উৎপাদন হয় কালীগঞ্জ উপজেলায়। এ উপজেলার ত্রিলোচনপুর গ্রামের সফল ফুলচাষী ও ব্যবসায়ী এস এম টিপু
সুলতান একই ১২ বিঘা জমির উপর বিভিন্ন ফুলের চাষ করেছেন। তার চাষ করা ফুলের মধ্যে রয়েছে, গোলাপ, জারবেরা, চন্দ্র মল্লিকা। সফল ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী এস এম টিপু সুলতান জানান, তিনি ২৮ বছর ধরে ফুলের সাথে জড়িত। ঢাকায় তার ফুলের দোকানও আছে। সেখানে তিনি ফুলের ব্যবসা করেন। তিনি নিজে শেরে বাংলা নগর ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সহ-সাধারণ সম্পাদক। তিনি সর্ব প্রথম গ্লাডিওলাস দিয়ে ফুলের চাষ শুরু করেন। এরপর জারবেরা ফুলের আবাদ করেন। সর্বশেষ গত ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডের ফুল লিলিয়ামের চাষ করেন। কিন্তু সময় মত ফুল না উঠায় সে বছর তিনি তেমনভাবে ফুল বিক্রি করতে পারেনি। এবার তিনি, সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে জারবেরা, সাড়ে ৩ বিঘা জমিতে গোলাপ
ও বাকি ৩ বিঘা জমিতে চন্দ্র মল্লিকাসহ অন্যান্য ফুলের করেছেন। তিনি জানান, ভালবাসা দিবস উপলক্ষে গোলাপ ফুলের বেশি চাহিদা থাকে। বর্তমানে একটি গোলাপ ফুল ৩০ থেকে ৩৫ , একটি জারবেরা ফুল ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফুলের কোয়ালিটির উপর দাম নির্ভর করে।তিনি আরো জানান, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফুলের ব্যবসা ভাল হয়। এ সময় ফুলের দাম ভাল পাওয়া যায়। সে সময় তিনি পাইকারী হারে ১টি জারবেরা ৫/১০ টাকা, গোলাপ ১০ থেকে ১২ টাকা করে বিক্রি করে থাকেন। অবশ্য বাজার ভাল হলে দাম বেশি পাওয়া যায়। আসছে বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দুইটি দিবসে তিনি একাই ১০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশা করছেন। ফুল ব্যবসায়ীরা তার কাছ থেকে পাইকারী হারে ফুল কিনে নিয়ে যান। এসব ফুল কালীগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকা, চট্রগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফুলচাষী শামীম হোসেন জানান, তার ১০ বিঘা জমিতে জারবেরা, গোলাপ, চন্দ্র মল্লিকা ও গাঁদা ফুলের চাষ রয়েছে। তিনি প্রতিদিনই বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফুল বাজারে ফুল বিক্রি করতে আসেন। উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের ডুমুরতলা গ্রামের ফুলচাষি মিজানুর রহমান জানান, তারা গাঁদা ফুলের চাষ করেন। চলতি বছর তিনি ৫ কাঠা, একই এলাকার মোহাম্মদ আলী ও এমদাদুল হক দুই ভাই মিলে ৮ কাঠা, আব্দুল আলীম ৫ কাঠা জমিতে ফুলের আবাদ করেছেন। তিনি আরো জানান, দড়িতে ফুল গেঁথে ঝোপা তৈরি করা হয়। এক ঝোপায় সাড়ে ৭শ থেকে ৮শ গাঁদা ফুল থাকে। ফুলের মূল্য কম থাকলে এক ঝোপা বিক্রি হয় ২০০ টাকায়। দাম বাড়লে সর্বোচ্চ ৭শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন।এসব ফুল বিক্রির জন্য সরকারি ভাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে কালীগঞ্জের বালিয়াডাঙ্গা বাজারে একটি ফুলের বাজার করে দেওয়া হয়েছে। যেটির নাম দেওয়া হয়েছে- “বালিয়াডাঙ্গা ফুল বিপণন কেন্দ্র”নামে। এই বাজারে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম হরেক রকমের ফুল এনে বিক্রি করা হয়। কালীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার আবাদ করা ফুল যাচ্ছে, ঢাকা, চট্রাগ্রাম, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, খুলনা, যশোর, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, সৈয়দপুর, মাদারীপুর, জামালপুর, শেরপুর, রংপুর, নওগা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলাতে। বালিয়াডাঙ্গা বাজার থেকে পাইকারী ফুল কেনার জন্য এখানে ফজলু খা, রবিউল ইসলাম, মইদুল খা, আব্দুর শেখ, জামাল হোসেন, শামীম রেজাসহ ২৫ থেকে ৩০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। এছাড়া এই উপজেলায় প্রায় ছোট বড় ২ হাজার ফুল চাষী রয়েছেন। কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর, বালিয়াডাঙ্গা, তিল্লা, সিমলা, রোকনপুর, গোবরডাঙ্গা, পাতবিলা, পাইকপাড়া, তেলকূপ, গুটিয়ানী, কামালহাট, বিনোদপুর, দৌলতপুর, রাড়িপাড়া, মঙ্গলপৈতা, মনোহরপুর, ষাটবাড়িয়া, বেথুলী, রাখালগাছি, রঘুনাথপুরসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের মাঠে ফুল চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গাঁদা ফুল চাষ হয় কালীগঞ্জে বালিয়াডাঙ্গা এলাকায়।
এ কারণে সবাই এখন এই এলাকাকে ফুলনগরী বলেই চেনেন। বর্তমানে ফুলের বাজার ধরতে ও ভালবাসার সৌরভ ছড়াতে চাষীরা ফুল তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনি জানান, ঝিনাইদহ জেলার মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলায় ফুল চাষ বেশি হয়ে থাকে। এখানে বিদেশি ফুল জারবেরা, লিলিয়াম, গ্লাডিওলাসের মত ফুলের চাষ হয়। চাষীদের ফুল বিক্রির জন্য বালিয়াডাঙ্গা বাজারে সরকারিভাবে কৃষি বিপণন কেন্দ্র করে দেওয়া হয়েছে। ফুল প্রসেস করার জন্য প্রি-কুলিং সেন্টারও আছে। এছাড়া তারা নিয়মতভাবে ফুলচাষীদের ফুলের রোগ বালাই সম্পর্কে পরার্মশ প্রদান, বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অন্তর্ভুক্তি করছেন। তিনি আরো জানান, ভাল মানের ফুল হলে সেটি বিদেশে রপ্তানির জন্য চেষ্টা করা হবে।