চারুকলার শিক্ষক শিল্পী ড. আবদুস সাত্তারকে নতুন করে পরিচয় করার প্রয়োজন নেই। তিনি নিজ প্রতিভায় বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন। কিন্তু এ শিল্পীর একটি অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে, গত একুশে বইমেলায় প্রকাশিত তার অনন্য গ্রন্থ,‘ বাংলার চিত্রে প্রচ্যশৈলী সন্ধান’ প্রকাশের পর। গ্রন্থটির সূত্রে প্রকাশ, ১৯৮৮ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার লুবিয়ানার আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় দ্বিবার্ষিক গ্রাফিক আর্ট প্রদর্শনীর পরিচালক প্রফেসর ড. জোরান ক্রিজনিক তাকে জানিয়েছেন, ওয়াল্ড বেস্ট গ্রাফিক আর্টিস্ট হিসেবে তাকে মনোনীত করা হয়েছে। তাকে জাপানে অনুষ্ঠিত ‘দ্য প্রিন্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড বেস্ট গ্রাফিক’ আর্টিস্টদের প্রদর্শনীতে চিত্রকর্ম পাঠানোর জন্য সেই সময় অনুরোধ করা হয়েছিল। এ স্বীকৃতি তারাই পেয়েছেন যারা লুবিয়ানা আন্তর্জাতিক দ্বিবার্ষিক গ্রাফিক আর্ট এবং ক্রাফো আন্তর্জাতিক ত্রিবার্ষিক প্রিন্ট প্রদশর্নীতে পুরস্কৃত হয়েছেন। ৪০টি দেশের ১২৫জন শিল্পীকে স্বতন্ত্রধারারার সৃষ্টিকর্মের জন্য এমন বিরল সম্মানজনক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, ১৯৮৮ সালে। তাকে দেয়া এমন বিরল সম্মানের কথা এদেশের মানুষ জানতে পারলো সুদীর্ঘ ৩৫ বছর পর।
বাংলাদেশে যে ক’জন চিত্রশিল্পী তাদের অক্লান্ত মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে চিত্রশিল্পের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন, শিল্পী আবদুস সাত্তার তাদের অন্যতম। নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ এই শিল্পী নীরবে নিভৃতে মুক্তা ফলিয়েছেন ঝিনুকের মতো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শিল্প হলো একটা তৃষ্ণা, অর্থাৎ খুঁজে বেড়ানো। শিল্প হলো সেই ব্যাপক অনুসন্ধানের সুখ।’ শিল্পী আবদুস সাত্তার সেই তৃষ্ণা নিয়ে সৃষ্টির নেশায় খোঁজে ফিরছেন দেশ থেকে দেশান্তরে, প্রচুর পড়াশুনা করেছেন। দেখেছেন বিশ্ববরেণ্য শিল্পীদের শিল্পকর্ম, গবেষণা করেছেন। বিদেশে নিজ দেশকে উপস্থাপন করেছেন, পরিচিত করেছেন। শিল্পী আবদুস সাত্তার একজন সচেতন শিল্পী। তিনি শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করছেন। একটা সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে আঁকছেন। লিখছেন এবং শিল্পী তৈরিও করছেন। একজন মানুষের এত কিছু করা কী করে সম্ভব?
শিল্পী ড. আবদুস সাত্তার বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি আন্দোলনের একজন উদ্যোক্তা। তিনি বাংলা ও আরবি ক্যালিগ্রাফি নিয়ে সাতটি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তার দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক শিল্পী ড. অধ্যাপক আবদুস সাত্তার দেশে ও বিদেশে অনেক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ক্যালিগ্রাফিকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রসারিত ও সমাদৃত করেছেন। মালয়েশিয়ার জাতীয় চিত্রশালায় শিল্পী ড. আবদুস সাত্তারের ক্যালিগ্রাফি সংরক্ষিত আছে। তার কাজে ইসলামিক আর্টের প্রভাব রয়েছে। রয়েছে আমাদের দেশ, জাতিসত্তার ইতিহাস, ঐতিহ্য। নিজ মাটির ঘ্রাণ।
প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক থাকাকালীন আবদুস সাত্তার তার বিভাগের শিল্প শিক্ষাদানের পাশাপাশি মাস্টার ডিগ্রি শিক্ষার্থীদের নন্দনতত্ত্বের বিষয় পড়াতেন। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ প-িত সৈয়দ আলী আহসান নন্দনতত্ত্বের যে ক্লাস নিতেন সে ক্লাস অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি নিচ্ছেন। তিনি নন্দনতত্ত্বের ওপর গবেষণা করেছেন। শিক্ষার্থীদের নন্দনতত্ত্বের সঠিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি মনে করেন। যাতে শিল্প সম্পর্কে জ্ঞান থাকে, ভালো শিল্প মন্দ শিল্প বুঝতে পারে। শিল্প সমালোচনা ও এই বিষয়ে লেখালেখি করতে পারে। শিল্প সৃষ্টি তার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। শিল্পী আবদুস সাত্তার জীবনের প্রতিটি ধাপে নান্দনিকতা খুঁজে বেড়ান এবং শিক্ষার্থীদের জন্য এ বিষয়ে জাতীয় দৈনিকে প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রকাশিত প্রবন্ধের সমন্বয়ে নন্দনতত্ত্বের ওপর বই ‘প্রকৃত শিল্পের স্বরূপ সন্ধানে’ শীর্ষক পুস্তক প্রকাশ করেছেন।
শিল্পী আবদুস সাত্তার প্রাচ্য চিত্রকলা ও ছাপাচিত্র এই দুটো মাধ্যমেই দক্ষতা অর্জন করেন ও তার স্বাক্ষর রাখছেন। তার শিল্পে ফুল, লতাপাতা ফিগার, পাখি বিমূর্ততা ইত্যাদি একান্তই নিজস্ব ফর্মে রেখার ডেকোরেটিভ ধারায় কম্পোজিশন করেছেন। প্রচুর নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন। ছাপচিত্রে তিনি কতটা দক্ষ তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ’ ৮১ তে ‘পোড়াকাঠে গোলক’ শীর্ষক বিমূর্তার ধারায় উডকাঠ শিল্পটির মাধ্যমে। এই শিল্পকর্মের জন্যই তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এই শিল্পের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক এই শিল্পটি দর্শকদের মনে যুদ্ধকালীন বর্বরতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। যার স্বাক্ষর এখনো রেখে চলেছেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রদর্শনীতে পুরস্কার, ১৯৮০ সালে জল রঙে ‘বর্ষা’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে পুরস্কার এবং ১৯৮০ সালেই যুগাস্লাভিয়ার লুবজানায় অনুষ্ঠিত চতুর্দশ দ্বিবার্ষিক শিল্পকলা প্রদর্শনীর পারচেজ পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৮১-এর নবীনশিল্পী জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে ছাপচিত্রে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েও তিনি এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। শিল্পী আবদুস সাত্তার কয়েকটি বিষয়ের ওপর সিরিজ কাজ করেন। রেড সার্কেল, নেট প্রিন্ট, পোড়াকাঠের সিরিজ উল্লেখযোগ্য। হোটেল সোনারগাঁয়ে ছাপাচিত্র ও তেল রঙে আঁকা তার ৩০০ শিল্পকর্ম রয়েছে।
শিল্পী আবদুস সাত্তার প্রতিভাবান মেধাবী, দক্ষ ও পরিশ্রমী একজন শিল্পী। শিল্পচর্চায় গভীর আত্মনিয়োগ ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা তাকে মহান শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সারিতে উন্নীত করেছে। তার পা-িত্য সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাই তাকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এতগুলো পুরস্কারে ভূষিত করে।
শিল্পী আবদুস সাত্তার ১৯৪৮ সালে নাটোর জেলায় চকবড়াইগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আলহাজ নাজির উদ্দিন সরকার ও মাতা আনেছা বেগম। শিক্ষাজীবন শুরু হয় বড়াইগ্রামের পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের কভার ও ভেতরের ছবি তাকে ভীষণ আকৃষ্ট করত। ফলে ক্লাসের খাতাতেই ছবি আঁকা শুরু করেন। ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের ছবিই তাকে শিল্পী হতে উৎসাহিত করেছে।
তিনি নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাস করেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে এইচএসসি ১৯৬৪-১৯৬৬। ঢাকার চারুকলা অনুষদ থেকে বিএফএ ডিগ্রি (প্রথম স্থান) ১৯৭১। ভারত সরকারের স্কলারশিপের অধীন বিশ্বভারতীর কলাভবনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ১৯৭৩-১৯৭৫। চারুকলা অনুষদ থেকে এমএফএ ডিগ্রি (প্রথম শ্রেণীতে প্রথম)। আমেরিকা সরকারের ফুলব্রাইট গ্রান্টের অধীনে নিউইয়র্কের প্রাট ইনস্টিটিউট থেকে ডিস্টিংশনসহ ছাপচিত্রে এমএফএ ডিগ্রি, ১৯৮৭। পিএইচডি ২০০০ সাল। এছাড়া ভারতের চুনারে স্টোন কার্ভিং ক্যাম্প, আমেরিকা জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ লিটারেচার এবং দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের স্কলারশিপে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে কোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে কোরিয়া ল্যাংগুয়েজে অংশগ্রহণ তিনি একুশটির বেশি একক এবং দেশে-বিদেশে অসংখ্য যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। দু’টি স্বর্ণপদকসহ সাতটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং একটি স্বর্ণপদকসহ দেশে ৯টি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন জাপান থেকে সার্টিফিকেট অব মেরিট, পেয়েছেন তাইওয়ানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু সার্টিফিকেট। পেয়েছেন বহু সম্মাননা ক্রেস্ট।
আমেরিকার পোর্টল্যান্ড আর্ট মিউজিয়াম, নরওয়ের মিউজিয়াম অব কন্টেম্পোরারি গ্রাফিক আর্ট, মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, যুগোস্লাভিয়ার মিউজিয়াম অব কন্টেম্পোরারি গ্রাফিক আর্ট, মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, যুগোস্লাভিয়ার মিউজিয়াম অব কন্টেম্পোরারি আর্টসহ দেশে-বিদেশে বহু প্রতিষ্ঠানে লেখক ও শিল্পী সাত্তারের শিল্পকর্ম সংগৃহীত হয়েছে। এছাড়া দেশে-বিদেশে অসংখ্য ব্যক্তির সংগ্রহে রয়েছে সাত্তারের শিল্পকর্ম।
বাংলাদেশে ড. আবদুস সাত্তারই একমাত্র শিল্পী যার শিল্পতত্ত্বের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য রয়েছে। তার রয়েছে ২০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে তালিকাভুক্ত। ড. আবদুস সাত্তার দেশের পত্রপত্রিকায় নিয়মিতভাবে শিল্পকলা এবং রাজনীতি বিষয়ে কলাম লিখে থাকেন। বর্তমানে ড. আবদুস সাত্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের অনারারি প্রফেসর। তার লেখা প্রকাশিত উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ : ১. শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ২. শিল্পের উপকরণ ও ব্যবহার পদ্ধতি ৩. প্রকৃত শিল্পের স্বরূপ সন্ধান ৪. শিল্প সংস্কৃতি রাজনীতি ৫. শিল্পকলা যুগে যুগে ৬. শিল্পপ্রেমী জিয়া ৭. জয়নুলের এগারোজন সহকর্মী ৮. বাংলাদেশের নতোন্নত দারুশিল্প, ৯. অলঙ্কার ১০. ল্যান্ডস্কেপ ১১. আবদুস সাত্তারের শিল্পকর্ম ১২. পশ্চিমা শিল্পের আগ্রাসন ও পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্ব ১৩. সোমনাথ হোরের পত্র ও কলকাতার চিত্র ১৪. শিল্পের আনন্দ ১৫. প্রাচ্যচিত্রের সৌন্দর্য ১৬. বাংলার চিত্রে প্রচ্যশৈলী সন্ধান ইত্যাদি।
শিল্পী আবদুস সাত্তার তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান চারুকলা অনুষদ থেকে অবসর নিলেও কাজ থেকে অবসর নিতে পারেননি। বিপুল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার তাকে তাড়া করে ফিরছে। তিনি ছবি আঁকছেন, শিল্পকলার ওপর বই লিখছেন। লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে সমাজব্যবস্থার ওপর।
তিনি বলেন, ‘শিল্পী জীবনের কোনো অবসর নেই। একজন শিল্পী আমৃত্যু শিল্পচর্চা করে থাকে। কর্ম-পাগল শিল্পীর ভাষা কাজ করাটাই আমার আনন্দ। আমি আনন্দময় জীবন অতিবাহিত করছি।’