দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য স্বল্প মূল্যে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস বিক্রি শুরু করে সরকার। প্রথম রোজা থেকে রাজধানীর ২৫টি স্থানে পিকআপ কুলভ্যানে এবং ৫টি স্থানে স্থায়ী বাজারে স্বল্প মূল্যের এসব পণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু হয়। তবে দুই দিন না পেরোতেই এই কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আসতে শুরু করেছে অভিযোগ। ঘোষিত ২৫টি স্থানে যেমন তাদের কার্যক্রম খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি বিক্রয় নিয়েও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। চাহিদার তুলনায় কম পণ্য আসারও অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। গত বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) সচিবালয়ের দক্ষিণ গেটের অপর পাশে, শিল্পকলা একাডেমির গেটের পাশে ও সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের সামনে সকাল থেকে সরেজমিনে অবস্থান করে দেখা যায় এই অনিয়মের চিত্র। সচিবালয় ও শিল্পকলা একাডেমির গেটের পাশে পিকআপ কুলভ্যানে বিক্রি করতে দেখা যায় গরু ও খাসির মাংস, ড্রেসড ব্রয়লার মুরগির মাংস ও তরল দুধ। বিক্রেতাদের ভাষ্যমতে, গতকাল রাতে ডিম বহনকারী ট্রাক দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় আজ ডিম বিক্রি আপাতত বন্ধ আছে। এ ছাড়া সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের সামনে বিক্রি করতে দেখা যায় রুই, পাবদা, তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছ।
সচিবালয়ের দক্ষিণ গেটের অপর পাশে ওসমানী মিলনায়তনের সামনে পিকআপ কুলভ্যানে বিক্রি করতে দেখা যায় গরু, খাসি ও মুরগির মাংস এবং ড্রেসড ব্রয়লার মুরগির মাংস ও তরল দুধ। এ সময় সেখানে ছিল প্রায় ৫০ জনের একটি লাইন। স্বল্প মূল্যে পণ্য কিনতে এসেছিলেন এনামুল হক। সকাল ৯টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় ১ কেজি গরুর মাংস আর ২ লিটার দুধ কিনতে পেরেছেন বলে জানান এনামুল। অভিযোগ করে তিনি বলেন, এখানে একজন ব্যক্তিকে ২ থেকে ৩ কেজি মাংস এবং ৪ লিটার করে দুধও দেওয়া হচ্ছে। আবার একজনকেই একটার বেশি স্লিপ দেওয়া হচ্ছে কেনার জন্য। অথচ আমরা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে পুড়ছি। কেউ কিনতে পারছে, আবার কেউ পারছে না। এখানেও দুর্নীতি হচ্ছে, অনিয়ম হচ্ছে।
আরেক ক্রেতা তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু এখানে অনেকেই এসে নিজেদের কী কী সব পরিচয় দিয়ে লাইন ভেঙে আগে থেকে বেশি করে নিয়ে যাচ্ছে। পরে আমরা পাবো কি না তার কোনও ঠিক নেই।
আধা ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শফিক প্রধান নামের এক ক্রেতা ১ কেজি খাসির মাংস আর ৪ লিটার দুধ কিনে নেন। পরে এসে আগে নিলেন কীভাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, খাসির মাংসের চাহিদা কম আর অন্যদের রিকোয়েস্ট করে নিতে পেরেছি। ৪ লিটার দুধ কীভাবে নিলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি চেয়েছি আর তারা দিল। ২ লিটারের বেশি নেওয়া যাবে না, এমন কিছু বলেনি তারা। অল্প কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় আরও এক ব্যক্তি তাকে (শফিক প্রধান) আরও এক কেজি খাসির মাংস আর দুই লিটার দুধ দিয়ে যায়। এ সময় তার সাথে কথা বলতে গেলে তিনি সেখান থেকে চলে যায়।
আরেক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এসেছিলেন স্বল্প মূল্যে পণ্য কিনতে। তিনি ২ কেজি গরুর মাংস আর ৪ লিটার দুধ কেনেন। কীভাবে পরিমাণের বেশি মাংস-দুধ কিনলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, খাসির মাংস নেই বলে আমাকে ২ কেজি গরুর মাংস আর ৪ লিটার দুধ দিয়েছে।এই কেন্দ্রের ক্যাশিয়ার এনামুল হক জীবনের কাছ থেকে জানা যায়, তারা আজ ১২০ কেজি গরুর মাংস, ২০ কেজি খাসির মাংস, ড্রেসড ব্রয়লার মুরগির মাংস এবং ১৫০ লিটার তরল দুধ এনেছিলেন। সকাল ১০টা ১০ মিনিট থেকে বিক্রি শুরু করে বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে আমাদের সব পণ্য শেষ হয়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ক্রেতা সর্বোচ্চ ১ কেজি গরুর মাংস, ১ কেজি খাসির মাংস, ১ কেজি মুরগির মাংস, ১ ডজন ডিম ও ২ লিটার দুধ কিনতে পারবেন। যাতে কিনতে আসা সবার কাছেই পণ্য পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু সচিবালয়ের এই বিক্রয়কেন্দ্রে অনেক ব্যক্তিকে দেখা যায় এক কেজির বেশি পরিমাণ মাংস কিনতে। আবার অনেকে একাধিক ক্রয়ের স্লিপ সংগ্রহ করে একাধিকবার পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে এক ব্যক্তিকে একাধিক ক্রয় স্লিপ দেওয়ার নিয়ম নেই।
নিয়মের বাইরে গিয়ে এক ব্যক্তিকে পরিমাণের চেয়ে বেশি পণ্য কেনার সুযোগ দেওয়া নিয়ে ক্যাশিয়ার এনামুল হক জীবনের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনও উত্তর দেননি। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বিশ্বাস কাকরাইল, বনানী ও সচিবালয়ের স্বল্প মূল্যের পণ্য বিক্রয়কেন্দ্রের মনিটরিংয়ের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, লাইনে যারা দাঁড়ায়, তারা প্রত্যেকে যেন পায়, সে জন্য একজন ব্যক্তিকে ১ কেজির বেশি মাংস, ১ ডজনের বেশি ডিম ও ২ লিটারের বেশি দুধ দেওয়ার নিয়ম নেই।
নিয়ম না থাকলেও একজন ব্যক্তিকে ১ কেজির বেশি মাংস ও ২ লিটারের বেশি দুধ দেওয়া হচ্ছে, এমনটা তাকে জানালে তিনি বলেন, আমার এটা জানা নেই, আমি দেখিনি। আমি অন্য স্পটে ছিলাম। কিন্তু যদি এটা আসলেই করা হয়ে থাকে, তাহলে এটা নিয়ম ভেঙে হয়েছে। আমাদের স্ট্রিক্টলি নিষেধ আছে যাতে কাউকে পরিমাণের বেশি পণ্য দেওয়া না হয়। তবে বেলা শেষের দিকে যদি ডিম দুধ থেকে যায়, তখন সেগুলো শেষ করার জন্য সামান্য বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
অন্যদিকে শিল্পকলা একাডেমির গেটের পাশে কুলভ্যানের ক্যাশিয়ার মনির হোসেন জানান, তারা আজ ৯০ কেজি গরুর মাংস, ৫ কেজি খাসির মাংস, ৪০ কেজি মুরগির মাংস এবং ১২০ লিটার তরল দুধ এনেছিলেন। সকাল ১০টা থেকে বিক্রি শুরু করে দুপুর ১২টার মধ্যে আমাদের সব পণ্য শেষ হয়ে গেছে।
তাদের আনা পণ্যগুলো চাহিদার তুলনায় ছিল অনেকটাই কম। ক্রেতারা এসে তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য না পেয়ে ফিরে যান খালি হাতেই। আবার অনেকে যা চেয়েছেন, তা না পেয়ে অন্যকিছু নিয়ে চলে গেছেন।
আব্দুর রহমান নামের এক ক্রেতা বলেন, খাসির মাংস কিনতে এসে পেলাম না। শুনেছি তারা নাকি ৬ থেকে ৭ কেজি এনেছিলেন। এত কম আনলে কয়জন মানুষকে তারা দিতে পারবে? আহসান হাবিব নামের আরেক ক্রেতা বলেন, আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। চেয়েছিলাম গরুর মাংস কিনবো কিন্তু পেলাম না। আজ মুরগির মাংস আর দুধ কিনে নিয়ে গেলাম। পরে অন্য কোনো দিন এসে গরুর মাংস কিনে নিয়ে যাবো।
এদিকে সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের সামনে দেখা যায় নির্ধারিত মূল্যে রুই, পাবদা, পাঙাশ, তেলাপিয়া মাছ বিক্রি করতে। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ২ কেজি মাছ কিনতে পারবেন বলে জানানো হলেও এক ব্যক্তির কাছেই ৩টি দেড় কেজি ওজনের রুই মাছ বিক্রি করতে দেখা যায়।
এ সময় বাজার করতে আসা সেগুনবাগিচা এলাকার বাসিন্দা সওগাতুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ১২টার আগেই সব শেষ। আমি আসার পর দেখলাম, কয়েকজন ৩ থেকে ৪ কেজি করে মাছ নিচ্ছে। বিক্রেতারা দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য একজনের কাছে বেশি পরিমাণে পণ্য বিক্রি করছে।
মৎস্য অধিদফতরের উপপ্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ চৌধুরী বিক্রয় কার্যক্রম প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জনের কাছে মাছ বিক্রি করা হচ্ছে। ১২টার মধ্যেই মাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ কেজি মাছ নিয়ে আসা হয় বলে জানান তিনি।- বাংলাট্রিবিউন