চিকিৎসাসেবায় অবদান রাখায় স্বাধীনতা পদক-২০২৪ এর জন্য মনোনীত হয়েছেন ময়মনসিংহ নগরীর পারমিতা চক্ষু হাসপাতালের স্বত্বাধিকারী চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. হরিশংকর দাশ। এ খবরে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে চিকিৎসকসহ সাধারণ মহলে। শুক্রবার (১৫ মার্চ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত ১০ জনের তালিকা প্রকাশের পর আলোচনায় আসে ডা. হরিশংকর দাশের নাম। গত রোববার (১৭ মার্চ) নগরীর পারমিতা চক্ষু হাসপাতালে কথা হয় ডা. হরিশংকর দাশের সঙ্গে। এসময় তিনি তুলে ধরেন তার ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবনের আদ্যোপান্ত।
ডা. হরিশংকর দাশ বলেন, ‘কর্মজীবনে ৫২ বছর পার করেছি। দীর্ঘ কর্মজীবনের পর আজকের এই মূল্যায়নে আমি অভিভূত ও পুলকিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তিনি আমাকে এ মহান পদকে মনোনীত করেছেন। যতদিন বেঁচে থাকবো, মানুষের সেবা করে যেতে চাই।’ তরুণ চিকিৎসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমার এ পদকপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে সৎ মনে কাজ করলে মূল্যায়ন একদিন হবেই। যারা সৎকাজ করবে, তাদের পুরস্কার আছে এবং থাকবেই। তবে কর্মে থাকতে হবে সেবার মনোভাব। একজন চিকিৎসক কখনো টাকার মেশিন হতে পারে না। তবেই তার জীবন হবে সার্থক।’
স্মৃতিচারণ করে ডা. হরিশংকর বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকেই আমার ইচ্ছে ছিল চিকিৎসক হবো, মানুষের সেবা করবো। এরই মাঝে ১৯৭১ সালে শুরু হয় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তখন আমি মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ওই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আমি চলে যাই ভারতের আসাম প্রদেশের মাইনকা চর এলাকায়। সেখানে টানা চার মাস মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় জীবনবাজি রেখে কাজ করেছি। এ খবরে পাক-বাহিনী টাঙ্গাইল ভূঞাপুর উপজেলার নিকলা গোপাল গ্রামে আমাদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়। এরপর ’৭৪ সালে ডাক্তারি পাস করে নিয়মিত রোগী দেখা শুরু করি। কখনো টাকা-পয়সার চাহিদা বেশি করিনি। অনেক সময় রোগীর গাড়িভাড়া ও ওষুধ আমাকে দিয়ে দিতে হয়েছে।’ করোনাকালের কথা উল্লেখ করে স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত এ চিকিৎসক বলেন, ‘করোনাকালে আমি ডায়াবেটিস, কিডনি ও প্রেসারের রোগী। তখন অনেক ডাক্তার কারোনা আক্রান্তদের কাছে যায়। কিন্তু আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৪ ঘণ্টা আমার হাসপাতাল খোলা রেখে রোগীদের সেবা দিয়েছি। এতে আমি নিজেও করোনা আক্রান্ত হই। কিন্তু রোগীদের ছেড়ে আমি পালিয়ে যাইনি। এভাবেই আজীবন রোগীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই।’ চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. হরিশংকর দাশ উপজেলার অলোয়া ইউনিয়নের নিকলা গোপাল গ্রামের ইন্দু ভূষণ দাশের ছেলে। ডা. হরিশংকর দাশের বড় ভাই শিক্ষাবিদ শংকর দাশ ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
হরিশংকর নিকলা দড়িপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প ম শ্রেণি পাস করার পর ১৯৬৬ সালে কালিহাতীর নারান্দিয়া টিআরকেএন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৬৮ সালে ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমবিবিএসে ভর্তি হন। ১৯৭৪ সালে এমবিবিএস পাস করার নিজ উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন ডা. হরিশংকর। পরে ওই বছরেই বদলি হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৯৮১ সারে তাকে পদোন্নতি দিয়ে বরিশাল হাসপাতালে বদলি করা হয়। কিন্তু সেখানে তিনি যোগদান না করে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন।
উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ১৯৮২ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানীর ভিয়েনাতে যান ডা. হরিশংকর। সেখান থেকে তিনি চোখের চিকিৎসার ওপর ডিও ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ভিয়েনা থেকে ফিরে ময়মনসিংহ গিয়ে তার ছোট মেয়ে পারমিতার নামে ময়মনসিংহ চরপাড়ায় চক্ষু হাসপাতাল নির্মাণ করেন। সেখানেই তিনি চিকিৎসাসেবা দেন। এ হাসপাতালে প্রতিদিন তিনি এক ঘণ্টার জন্য ফ্রি চিকিৎসা দিতেন রোগীদের। এছাড়া গ্রামের বাড়িতে গিয়ে প্রতিবছর ফ্রি ক্যাম্প করে রোগীদের বিনামূল্যে সেবা দিতেন। এরমধ্যে ভারতের মহারাষ্ট্র থেকেও চক্ষু চিকিৎসা বিষয়ে ডিগ্রি নেন ডা. হরিশংকর।