জেলায় কালো সোনার চাষ বা পেঁয়াজের বীজ চাষে স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। ‘কালো সোনা’খ্যাত পেঁয়াজের বীজ চাষ করে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন ঠাকুরগাঁওয়ের চাষিরা। গত কয়েক বছরে ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় এবারও বীজ চাষে আগ্রহ দেখিয়েছেন কৃষকরা। কৃষি বিভাগ বলছে, চলতি বছর জেলায় ২৩ কোটি টাকার পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব বীজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অ লে। ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় জেলায় প্রতি বছরই বাড়ছে পেঁয়াজ বীজের উৎপাদন। দাম বেশি হওয়ায় এ বীজকে কৃষকেরা তুলনা করছেন সোনার সঙ্গে। চলতি মৌসুমে ৭৬ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৪৬ হেক্টর বেশি। প্রতি হেক্টরে ৯০০ কেজি বীজ হলে এ বছর প্রায় ৬৮ দশমিক ৪ মেট্রিকটন বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। চলতি মৌসুমে জেলায় ১১২ হেক্টর জমিতে পিঁয়াজ বীজ আবাদ হয়েছে। তবে এ বীজ চাষে কৃষকদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। প্রতি হেক্টরে ৯০০ কেজি বীজ হলে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৩ কোটি টাকা।
জেলার সদর উপজেলা , বালিয়াডাঙ্গী ও হরিপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ফসলি মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, সাদা কালো রঙের ফুলে ছেয়ে গেছে পেঁয়াজ বীজের ক্ষেত। মাঠজুড়ে বাতাসে দোল খাচ্ছে সাদা রঙের পেঁয়াজ ফুল। আর কৃত্রিমভাবে পেঁয়াজের ফুলে পরাগায়ন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। গ্রামে মাঠের পর মাঠে দেখা মেলে সাদা কালো রঙের ফুলে ছেয়ে গেছে পেঁয়াজ বীজের ক্ষেত। এসব ক্ষেত করে শুধু কৃষকেরাই লাভবান হননি বরং স্থানীয় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান এর সৃষ্টির সুযোগ হয়েছে। পেঁয়াজ ক্ষেতে দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন স্থানীয় যুবকেরা। উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারকে সহায়তা করছেন যুবকেরা। মাঠে ঘুরে দেখা যায়, সকাল হলেই এসব বীজ ক্ষেতের পরিচর্যায় জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ সেচ দেয়, আবার কেউ পোকা দমনের কীটনাশক স্প্রে নিয়ে এবং কেউ হাতের আলতো ছোঁয়ায় পরাগায়ন করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এতে এলাকার শত শত নারী-পুরুষ এবং পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক কিশোর-কিশোরীরাও এসব কাজ করছেন। তবে কয়েকজন চাষির সাথে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত নভেম্বর মাস বীজতলায় বা জমিতে পেঁয়াজ বীজ বপনের সময় বীজ পরিপক্ব হতে সময লাগে ১৩০ দিন। পরাগায়ন না হলে পেঁয়াজ ফুলে পরিপক্বতা আসে না। আর এসব ফুলে পরাগায়নের প্রধান মাধ্যম হলো মৌমাছি। পোকার আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে কৃষকেরা ক্ষেতে কীটনাশক ছেটান। কিন্তু সেই কীটনাশকে মারা পড়ছে উপকারী পোকা ও মৌমাছি। এ কারণে পেঁয়াজ বীজের ক্ষেতে দিন দিন মৌমাছির আনাগোনা কমে যাচ্ছে। তাই ঝাড়– ও হাতের স্পর্শে কৃত্রিমভাবে পরাগায়নের চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে এসব ক্ষেত করে শুধু কৃষকেরাই লাভবান হননি বরং স্থানীয় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান এর সৃষ্টির সুযোগ হয়েছে। পেঁয়াজ ক্ষেতে দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন স্থানীয় যুবকেরা। তারা উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারকে সহয়তা করছেন। কারও কারও মিটছে পড়াশোনার খরচ।
চাষিরা বলছেন, পরাগায়ন না হলে পেঁয়াজ ফুলে পরিপক্বতা আসে না। পরাগায়ন হয়ে থাকে মূলত মৌমাছির মাধ্যমে। তবে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বীজের ক্ষেতে মৌমাছির আনাগোনা কমেছে। ফলে কৃত্রিম পরাগায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। আর এ বীজ চাষে উৎপানের সাথে সাথে বাড়ছে কৃষকদের আগ্রহ ও লাভের পরিমাণও।
সদর উপজেলার আখানগর বাজার এলাকায় প্রায় সাড়ে ৮ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পেঁয়াজের চাষ করেছেন ওই গ্রামের রহমত আলী। তিনি বলেন, ‘এ বছর বিঘা প্রতি বীজ, সার, কীটনাশক, মজুরি ও চাষাবাদসহ খরচ হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। ৮ বিঘা জমি থেকে ৫০ মণ বীজ উৎপাদন করে প্রায় ১ কোটি টাকার ওপরে বিক্রি করতে পারব।’
একই উপজেলার ইয়াকুবপুর গ্রামের চাষি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, এ বছর আমি ৩ একর জমিতে কালো সোনা পেঁয়াজের বীজ চাষ করেছি। সব মিলিয়ে ১০০ শতাংশ জমিতে আমার ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বিঘা প্রতি প্রায় ১০০ কেজি বীজ পাব বলে আশা করছি। গত বছর মানভেদে বিক্রি করেছি ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল গ্রামে মাঠের পর মাঠে দেখা মেলে সাদা রঙের ফুলে ছেয়ে যাওয়া পেঁয়াজ বীজের ক্ষেত। এসব ক্ষেত করে শুধু কৃষকরাই লাভবান হননি, স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
হরিপুর উপজেলার কাঁঠালডাঙ্গী এলাকার পেঁয়াজ চাষি স্বপন কুমার বলেন, অন্য কোনো ফসলে এমন লাভ করা যায় না। পেঁয়াজের বীজের কালো দানা আমাদের এলাকার কালো সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বাজারে যে পরিমাণ দাম পাওয়া যাচ্ছে এতে এ পেঁয়াজ বীজ আমাদের কাছে সোনার মতোই মূল্যবান।
স্বপন কুমারের জমিতে বীজ পরিচর্যায় নিয়োজিত শ্রমিক হরপা রায়, বিশ্বনাথ ও সুশিল বলেন, পেঁয়াজ বীজ পরায়ণ থেকে শুরু করে সংগ্রহ পর্যন্ত প্রচুর কাজ থাকে। এ সময় ভালো আয় হয় তাঁদের।
পেঁয়াজের বীজ চাষ করে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ বছর তিনি প্রায় ৩ বিঘা জমিতে পিঁয়াজের বীজ চাষ করেছেন। তার উৎপাদিত পিঁয়াজ বীজ সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। ফলন ভালো হওয়ায় প্রায় ৪ লাখ টাকা মুনাফার আশা করছেন তিনি। মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য উপযোগী হওয়ায় এ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন জেলার অন্য কৃষকরাও।
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) আলমগীর কবির বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় ১১২ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজ আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় এক হেক্টর কম। তবে এ বীজ চাষেণ কৃষকদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। প্রতি হেক্টরে ৯০০ কেজি বীজ হলে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৩ কোটি টাকা। আশা করা যায় সমমূল্যের বীজের উৎপাদন ও বিপণন হবে বাজারে এবার।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক (শস্য) ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, জেলায় কালো সোনার চাষ, ‘কালো সোনায়’ আশা দেখছেন চাষিরা। ঠাকুরগাঁওয়ে ২৩ কোটি টাকার ‘কালো সোনা’ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণেই পেঁয়াজের বীজ চাষে স্বপ্ন বুনছেন ঠাকুরগাঁওয়ে কৃষকরা। এ পেঁয়াজের বীজ চাষে একদিকে কৃষকদেও আগ্রহ, উৎপাদন ও লাভ বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে বিকল্প কৃষি কর্মসংস্থান। ঁেপয়াজ বীজ বা কালো সোনা চাষ নিয়মিত হলে এ অ লের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এই কালো সোনা ব্যাপক ভুমিকা রাখবে বলেও আশা করেন এ কৃষিবিদ।