দাবদাহে পুড়ছে আমের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত দেশের সীমান্তবর্তী বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলা নওগাঁ। গাছ থেকে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। পানি ও ওষুধ স্প্রে করে মিলছেনা সুফল। ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় চাষিরা চরম দুশ্চিন্তায়। তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। আমের গুটি ঝরে পড়া ঠেকাতে বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছেন আমচাষিরা। তারা বলছেন, কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে বাগানে পানি সেচসহ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেও ঝরে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাড়তি যত্ন নিলে গুটি ঝরে পড়া রোধ অনেকটাই সম্ভব। নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় প্রতি বছর বাড়ছে আম বাগান। ২০২৪ সালে ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম বাগান গড়ে উঠেছে। যা গত বছরের তুলণায় ৩০০ হেক্টর বেশি। ২০২২ সালে ছিল ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর। ২০২১ সালে ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর। ২০২০ সালে ২৪ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। ২০১৯ সালে ১৮ হাজার ৫২৭ হেক্টর। ২০১৮ সালে ১৬ হাজার হেক্টর। ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ৬৭০ হেক্টর। ২০২১ সালে এ জেলার আম্রপালি আমের মধ্যদিয়ে রপ্তানী শুরু হয়। ২০২৩ সালে ৭ জন চাষির মাধ্যমে ২২১ মেট্রিক টন আম্রপালি ও বেনানা ম্যাংগো ইতালি, সুইজারল্যান্ড, লন্ডন ও কাতারসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানী হয়। ২০২২ সালে ৭৮ মেট্রিক টন রপ্তানী হয়েছে। জেলায় বছরে আমের বাণিজ্য প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে প্রায় ১৫ হাজার জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে আম সংগ্রহের মৌসুমে এর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। চলতি মৌসুমে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৪ দশমিক ২৪ মেট্রিক টন হিসেবে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এবার বাগানে আশানূরুপভাবে আমের দেখা নেই। গুটি ঝরে পড়ে আছে রোদের তীব্রতায়। আমের নতুন রাজধানী খ্যাত নওগাঁর বেশিরভাগ আম বাগানেই ফলন বিপর্যয়ের আশংঙ্কা করছেন চাষিরা। খরা দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকলে আমের গুটিও ঝরতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে বাগানে ঘনঘন সেচ দিতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। বৈশাখের শুরু থেকে দাবদাহে পুড়ছে নওগাঁ। তপ্ত কড়াইয়ের মতো তেঁতে উঠছে পথ-ঘাট। আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করতে কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের পরামর্শে বাগানে ঢালা সেচ ও গাছে পানি ছিটাচ্ছেন চাষিরা। শুষ্ক এলাকা হিসেবে পরিচিত নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলার অনেক এলাকায় সেচসুবিধা নেই। ফলে বাগানে আম ঝরে পড়া রোধ করতে পারছেন না তারা। এ পরিস্থিতিতে বৃষ্টির জন্য চলছে হাহাকার। এদিকে, গত ২৭ এপ্রিল শনিবার বেলা ১১টায় নওগাঁয় তাপমাত্রার পারদ ওঠে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই চলতি মৌসুমে জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে জানায় বদলগাছীর কৃষি আবহাওয়া অফিস। আমচাষি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ১২ বিঘা জমিতে আমের বাগান আছে। এবার সব গাছে মুকুল কম এসেছিল। যেটুকু ছিল, তা নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে তীব্র গরমে অধিকাংশ গাছের গুটি ঝরে গেছে। অনেক গাছ গুটিশূন্য হয়ে আছে। পানি ও ওষুধ স্প্রে করে মিলছেনা সুফল। এতে উৎপাদন অনেক কম হবে বলে ধারণা করছেন তিনি। পোরশা উপজেলার আমচাষি মোজাম্মেল ইসলাম বলেন, এবার ৩০ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। গাছে গুটি কম থাকায় হতাশা ও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। গত বছর প্রচুর আম হয়েছিল। সে তুলণায় এবার অনেক কম ফলন পাবো। অধিকাংশ গুটি ঝরে গেছে। ফলনে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে বলে মনে করেন তিনি। বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, এ এলাকা এমনিতেই পানি সংকটাপন্ন। এর মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ। কোনো বৃষ্টি নেই। এ অবস্থা আরও কয়েকদিন চলতে থাকলে ২০-৩০ শতাংশ গাছ থেকে আমের গুটি ঝরে যাবে। যেসব বাগানে সেচের ব্যবস্থা আছে, সেসব বাগানে সেচ দেওয়া হচ্ছে। আর যেসব বাগানে সেচের ব্যবস্থা নেই, সেসব বাগানে আম ঝরে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ মেহেদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবছরই স্বাভাবিকভাবে এমন সময় গাছ থেকে আমের গুটি ঝরে পড়ে। তবে এই সময়ে গাছে বাড়তি পরিচর্যা করলে অস্বাভাবিকভাবে গুটি ঝরে পড়া বন্ধ হবে। আম গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সেচের পাশাপাশি প্রয়োজনে গাছের পাতায় পানি স্প্রে করা যেতে পারে। আমরা মাঠ পর্যায়ে চাষিদের আমের গুটি ঝরা রোধে সব ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত আমের উৎপাদনে বিপর্যয়ের কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, আমের গুটি ঝরে যাওয়ার পরও যে পরিমাণ আম থাকবে তা দিয়েই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব বলে দাবি তার।