ইমাম বুখারি নিশাপুরে ঠাঁই পেলেন না। তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দেখে চারদিকে কিছু হিংসুক তৈরি হলো। হিংসুকের হিংসা ও ভ্রষ্ট শাসকের জুলুমি সিদ্ধান্ত তাকে আর থাকতেই দিলো না নিশাপুরে। রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি হলো, ‘ঠিক এখনই নিশাপুর ত্যাগ করুন’। শাসকের ক্ষোভের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, রাজদরবারে গিয়ে তার ছেলেকে পড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয়া। রাষ্ট্রীয় ওই প্রস্তাবের জবাবে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জ্ঞান মজলিসে বসেই নিতে হয়, ঘরের দরজায় গিয়ে বিলি করা হয় না।’
ইমাম বুখারি রাহি: কিতাবাদি গুছিয়ে যাত্রা শুরু করলেন নতুন গন্তব্যের দিকে। যাবেন নিজ এলাকা বুখারাতে। তিনি বুখারাতে যখন পৌঁছলেন সর্বস্তরের মানুষ তাকে শহরের মূল প্রবেশদ্বারে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। মানুষের ঢল নেমেছিল সে দিন। সেই কি উচ্ছ্বাস, আনন্দ! বহুদিন পর যেন হারানো ধন খুঁজে পেলেম তারা। হঠাৎ যেন কী একটা হয়ে গেল বুখারায়। মানুষের দৃষ্টি একদিকেই। জনগণের এই পরিবর্তিত আচরণ নীতিনির্ধারকদের অনেকেই সইতে পারল না। হিংসায় জ্বলে উঠল। হিংসার সেই তাপ লাগল দরবারেও।
এ দিকে নিশাপুরের গভর্নর আরো বেসামাল। তার ক্ষোভ যেন কিছুতেই কমছে না। বুখারাতে ইমাম আশ্রয় নিয়েছেন- এই সংবাদ পেয়ে বুখারার গভর্নরের কাছে পত্র লিখল। পত্রের সারমর্ম ছিল এমন- ‘লোকটাকে নিশাপুর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আপনার রাজ্যের কল্যাণের জন্য ওকে বুখারা থেকেও বহিষ্কার করুন।’
বুখারার গভর্নরের রাগে যেন ঘি পড়ল। জ্বলে উঠল ছ্যাঁৎ করে। সাথে সাথে রাজকীয় পিয়নের মাধ্যমে বহিষ্কারাদেশ পাঠানো হলো। সেখানে লেখা ছিল- ‘ঠিক এই মুহূর্তে বুখারা ছাড়ুন’।
বাধ্য হয়ে ইমাম বুখারি রাহি: বুখারা ত্যাগ করলেন। কোথায় যাবেন তখন, তার জানা ছিল না। যেখানেই যাচ্ছিলেন সেখান থেকেই বের করে দেয়া হচ্ছিল। তিনি বুখারা থেকে বের হয়ে নির্জন প্রান্তরে তাঁবু টানিয়ে তিন দিন অবস্থান করছিলেন, যাতে সব কিতাবাদি সংগ্রহ করে সাথে করে নেয়া যায়। কারণ, এই জন্মস্থানে তো আর আসা হবে না। তার একান্ত সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ইবরাহিম বিন মাকিল।
হঠাৎ ইমামের মনে হলো, সমরকন্দের খারাতনাক গ্রামে তার এক আত্মীয়ের বসবাস। সেখানে চলে গেলে মন্দ হবে না। জীবনের বাকিটা সময় অপরিচিত সেই গ্রামের নির্জনতায় কাটিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিই বা করার আছে!
চললেন আত্মীয়ের বাসার দিকে। চলতে চলতে পৌঁছে গেলেন সমরকন্দের অন্তর্ভুক্ত খারাতনাক গ্রামে অবস্থিত আত্মীয়ের বাসায়। তারা ইমামকে খুশিতে বুকে টেনে নিলেন। গ্রামের মানুষ বেজায় খুশি।
এদিকে হিংসুকদের দৃষ্টিও ইমামের পেছনে পেছনে চলতে লাগল। সঙ্ঘবদ্ধ চক্র খবর রাখছিল, ইমাম বুখারি কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। যেখানেই আশ্রয় নেবে সেখান থেকেই তাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সমরকন্দের শাসকের কাছে রাষ্ট্রীয় চিঠি চালাচালি করে ইমামের অবস্থান শনাক্ত করে সেখান থেকে বহিষ্কার করার অনুরোধ জানাল। সমরকন্দের শাসক চিঠির হুকুম তামিল করল। রাষ্ট্রীয় বার্তাবাহক বহিষ্কারাদেশ ফরমান নিয়ে হাজির হলো অজোপাড়া সেই গ্রামে।
তখন ঈদের রাত। রাত পোহালেই ঈদুল ফিতর। চিঠিটাও লিখছিল সেভাবেই। ‘এখনই বের হোন, ঈদের পরে নয়’। এটি পড়ে ইমাম এক মুহূর্ত অবস্থান করার চিন্তা করলেন না। তিনি নিজের জীবনের চেয়ে আশ্রয়দাতা আত্মীয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন বেশি। ভাবলেন, যদি এখনই অর্থাৎ ঈদের রাতেই ত্যাগ না করি তাহলে বাড়ির কর্তাদের ওপর জুলুম করা হতে পারে।
আবার চললেন ইমাম বুখারি। বের হয়ে ২০ কদম এগোতে পারলেন না। ক্লান্ত হয়ে গেলেন খুব। এতটাই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন যে, তার স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। ইবরাহিম বিন মাকিলকে বললেন, যাতে সে তাকে একটু বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেয়। ইবরাহিম বিন মাকিল তড়িঘড়ি করে তার শায়খকে রাস্তার পাশেই বসিয়ে দিলেন। ইমাম বুখারি বসা থেকে শুইয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দিলেন। বিন মাকিল মনে করলেন, শায়খ আমার ঘুমুচ্ছেন। তিনি যাত্রা শুরু করার জন্য কিছুক্ষণ পর ইমামের মাথায় আলতো করে হাত রেখে ডাকতে থাকলেন। না, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এবার আরেকটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, ইমাম আর এই দুনিয়াতে নেই। তিনি তার রবের সাক্ষাতে বের হয়ে গেছেন। তিনি যে সময় ছন্নছাড়া হয়ে এই শহর থেকে ওই শহরে ঘুরছিলেন তখন তার বয়স ছিল ৬২ বছর। ১২০০ বছর পর আজ ইমাম বুখারির নাম সবার মুখেমুখে। কিন্তু যেই শাসক এবং হিংসুকরা তার পেছনে লেগেছিল তাদের নাম পর্যন্ত আজ অবশিষ্ট নেই। ইমাম বুখারিকে পড়বে, জানবে এবং রিসার্চ করবে কিয়ামত পর্যন্ত। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ ইমামের জ্ঞান থেকে ইস্তেফাদা নেবেন। তিনি উলুমুল হাদিসের রাজ্যে রাজাই থাকবেন। আর যারা তার পেছনে লেগে তাকে চরম কষ্ট দিয়েছিল তারা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই কবে!
শিক্ষা : চরম ত্যাগ ছাড়া পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় আদর্শ হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই।