শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৫ অপরাহ্ন

সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এলেও রিজার্ভের ক্ষয় এখনো অব্যাহত

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০২৪

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমুন্নত করতে নানামুখী উদ্যোগ চলমান রয়েছে দুই বছর ধরে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি গ্রহণের পাশাপাশি রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতেও নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। এর ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত মে মাসে দেশে রেমিট্যান্স বেড়ে কভিড-পরবর্তী সময়ে (তিন বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে) সর্বোচ্চে দাঁড়িয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এ সময় প্রবাসীরা দেশে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রায় ২২৫ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় এখনো অব্যাহত রয়েছে।
বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাবায়নের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫ জুন পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন (১ হাজার ৮৬৭ কোটি ১৬ লাখ) ডলারের কিছু বেশি। এক সপ্তাহ আগে ২৯ মে তা ছিল ১৮ দশমিক ৭২ বিলিয়নের কিছু বেশি (১ হাজার ৮৭২ কোটি ২৪ লাখ) ডলার। সে অনুযায়ী, এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের রিজার্ভ কমেছে ৫ কোটি ডলারের বেশি। তবে বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করে পাওয়া রিজার্ভও দেশের নিট বা প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নয়। নিট রিজার্ভ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেয়া এসডিআরসহ স্বল্পমেয়াদি বেশকিছু দায় বাদ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত এ হিসাব প্রকাশ করে না। তবে গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফ মিশনকে জানানো হয়েছিল দেশে ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসে। এ সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও দেখা দেয় নি¤œমুখিতা। দীর্ঘদিন ধরেই দেশে রিজার্ভের পরিমাণ টানা কমে আসছে। এর অন্যতম বড় কারণ হিসেবে ব্যাংক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে দেখা গেলেও বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে রিজার্ভে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৩৭ কোটি ২৫ লাখ ডলারে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে কভিডের মধ্যে এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।
রিজার্ভে অব্যাহত পতনের কারণ হিসেবে দেশের অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা দায়ী করছেন মুদ্রার বিনিময় হারে পতন ঠেকাতে বাজারে ক্রমাগত ডলার ছাড়াকে। জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার বাজেট বক্তব্য দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাইয়ের শেষে ছিল ৩৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়নের ভিত্তিতে), চলতি বছরের মে মাসের শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে। মুদ্রা বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়তে হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে।’ রিজার্ভের ক্রমাগত ক্ষয় সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে বিদেশী বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসছে না। রফতানিতে কিছু প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও তা প্রত্যাশার চেয়ে কম। বিদেশীরা ঋণ প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়—দুই-ই কমিয়েছে। পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন খাত থেকে বিদেশীরা বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন। মূলত এসব কারণেই দেশে রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। আর রিজার্ভের ক্রমাগত ক্ষয়ের কারণে আর্থিক হিসাবের ঘাটতিও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিক শেষে দেশে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ছিল ৯২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৯২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সে অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে দেশে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বেড়েছে ৬৩৩ কোটি ডলার।
একটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা হ্রাস-বৃদ্ধি হিসাব করা হয় আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে। এ হিসাবে ঘাটতি তৈরি হলে দেশের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়ে। চলতি শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই উদ্বৃত্তে ছিল বাংলাদেশের আর্থিক হিসাব। বিশেষ করে ২০১০ সাল-পরবর্তী এক যুগে কখনই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা যায়নি। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর শেষেও দেশের আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৬৯ কোটি ১০ লাখ ডলার। কিন্তু ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথম আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দেখা দেয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের আর্থিক হিসাবে এত বড় ঘাটতি এর আগে কখনই দেখা যায়নি। এ বিষয়টিই এখন ডলার সংকটের তীব্রতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
আর্থিক হিসাব পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে রিজার্ভেরও উন্নতি হবে না বলে মনে করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রেমিট্যান্স এখনো কোনো মাসে বাড়ছে, আবার কোনো মাসে কমছে। এখন কোরবানির ঈদের সময়। তাই স্বাভাবিকভাবেই রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। রেমিট্যান্স প্রবাহে এখনো আমরা ২০২০-২১-এর পর্যায়ে যেতে পারিনি। এ হিসেবে রেমিট্যান্স এখনো আশানুরূপ হয়নি। আর রিজার্ভে ক্ষয় ঠেকাতে না পারার প্রধান কারণ হলো অর্থ পাচারটা কমানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রচুর অর্থ পাচার হচ্ছে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টটা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। এটা না হলে রিজার্ভ গড়ে উঠবে না। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহ বাড়াতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইতিবাচক পর্যায়ে ছিল। সব দেশে ইতিবাচকই থাকে। ভারতসহ আরো অনেক দেশে এটা পজিটিভ। তাহলে আমরা কেন পারব না? বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি বন্ধ করেনি, তবে কিছু কমিয়েছে। বিক্রি তো পুরোপুরি বন্ধ হবে না। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট পজিটিভ করার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।’
রফতানির বিপুল পরিমাণ অর্থ অপ্রত্যাবাসিত থেকে যাওয়ার বিষয়টিও আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বড় করা ও রিজার্ভ সংকটে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো রেমিট্যান্সের অর্থ দেশের চলতি হিসাবের উদ্বৃত্তকে ইতিবাচক ধারায় রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু আর্থিক হিসাবকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রফতানি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি রফতানির অপ্রত্যাবাসিত অর্থ ফিরিয়ে আনায়ও মনোযোগ বাড়াতে হবে। রফতানির বড় অংকের অর্থ অপ্রত্যাবাসিত থেকে যাওয়ার কারণে দেশে ট্রেড ক্রেডিটের নিট ঘাটতি এখন ক্রমেই বাড়ছে, যা আর্থিক হিসাবের ঘাটতিকে বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি প্রকারান্তরে রিজার্ভের ক্ষয়েও অবদান রাখছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, দেশে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বড় করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে নিট ট্রেড ক্রেডিটের ঘাটতি। দেশে ট্রেড ক্রেডিটের নিট ঘাটতি এখন রেকর্ড ১২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন (১ হাজার ২২৪ কোটি) ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মে মাসে রেমিট্যান্সের যে পরিমাণ দেখা যাচ্ছে, তা মূলত আসন্ন কোরবানির ঈদকে ঘিরে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হলে শুধু রেমিট্যান্স যথেষ্ট না। রেমিট্যান্স চলতি হিসাবের উদ্বৃত্তকে পজিটিভ রাখে। কিন্তু আমাদের আর্থিক হিসাবের ব্যালান্স তো নেগেটিভ। এফডিআই আসছে না। রফতানির অর্থ প্রত্যাবাসন হচ্ছে না। এ ধরনের অনেক কারণে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থাকছে। আর এ ঘাটতির প্রভাব তো রিজার্ভের ওপর পড়বেই। এজন্য এফডিআই বাড়াতে হবে। রফতানি বাড়াতে হবে। ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট বাড়াতে হবে। এগুলো না হলে ফরেন রিজার্ভ বাড়বে না।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘এখন আমাদের পেমেন্টগুলো হচ্ছে। রেমিট্যান্স যত বাড়বে ব্যাংক খাতে তত বেশি আত্মনির্ভরশীলতা আসবে। তখন রিজার্ভ থেকে কম দিতে হবে। গত আকু পেমেন্টের পর থেকে রিজার্ভ প্রতিদিন অল্প হলেও বাড়ছে। যেহেতু এখন রেমিট্যান্সের প্রবাহ আসছে, ব্যাংকগুলোর কাছে ডলারও সুলভ হচ্ছে। নিট ওপেন পজিশনও ইতিবাচক হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি এখন হয়তো রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে আর সাপোর্ট করার প্রয়োজন হবে না। এ পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে হয়তো রিজার্ভের ক্ষয়টা আর হবে না এবং পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকবে।’- বণিক বার্তা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com