‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক, লা-শারিকা-লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক, লা শারিকালাক।’ অর্থ : আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোনো অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোনো অংশীদার নেই। হজের তালবিয়া পাঠে মুখরিত হবে আজ সৌদি আরবের আরাফাতের ময়দান।
আজ ৯ জিলহজ ১৫ জুন আরাফার দিবস। এ দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এ দিনে হাজিগণ মিনা থেকে আরাফার ময়দানে সমবেত হন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। এটিই হজের তিনটি ফরজের একটি। হজের ফরজ হলো তিনটি। ১। ইহরাম বাঁধা । ২। আরাফাতের মাঠে অবস্থান করা। ৩। তাওয়াফে জিয়ারত করা।
একজন মুমিনের কাছে বছরের যে কোনো দিনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ দিন হল আরাফার দিন। আল্লাহ তায়ালা ওইদিন যত বেশি মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন বছরের অন্য কোনো দিনে এত বেশি মানুষকে মুক্তি দান করেন না।
হাদিস শরিফে রাসুল (স.) বলেছেন, সারা বছরজুড়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে মানুষ যত দোয়া করে না কেন তার থেকে সবচেয়ে উত্তম দোয়া হলো আরাফার দিনের দোয়া। এ দিনে যে হাজিগণ আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন তারা ছাড়াও যারা হজ করছেন না তাদের জন্য রাসুল (স.) কতগুলো আমলের কথা বলেছে।
আরাফার দিনের (৯ জিলহজের) রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা রাখি যে তিনি আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’-আল-হাদিস
১. আরাফার দিনে যারা হজ করছেন না তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হল ওইদিন নফল রোজা রাখা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের (৯ জিলহজের) রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা রাখি যে তিনি আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)
২. আরাফার দিনে রাসুল (সা.) একটি দোয়া বেশি বেশি করে পাঠ করতে বিশেষ ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুল (স.) হাদিসে ইরশাদ করেন, আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ যত দোয়া পড়েছেন তার থেকে সবচেয়ে উত্তম দোয়া হচ্ছে এটি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শায়ইন কাদীর।’ (অর্থ) আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই, রাজত্ব একমাত্র তাঁরই, সমস্ত প্রশংসাও একমাত্র তাঁর জন্য, আর তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৮৫)
৩. বেশি বেশি দোয়া ও এস্তেগফার পড়া। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, সর্বোত্তম দোয়া হচ্ছে আরাফার দিনের দোয়া। এ দিনে দোয়া ও তওবা কবুলের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
আরাফার দিন বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে আরাফাতের দিনের তুলনায় উত্তম কোনো দিন নেই।’ (মাজমাউল জাওয়াইদ, হাদিস : ৩/২৫৬)
আরাফার দিনের দোয়া: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আরাফা দিবসের শ্রেষ্ঠ দোয়া এবং আমি ও পূর্ববর্তী নবীরা যা বলেছিল তার সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া হলো, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির। আরাফার ময়দানে অবস্থান হজের অন্যতম আমল। আরাফার ময়দান মক্কা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানেই হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন। যা ইতিহাসে ‘বিদায় হজের ভাষণ’ হিসেবে পরিচিত। এখানেই জিলহজ মাসের নবম দিনে ফজরের পর থেকে আরাফার দিবসের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে বেশি বেশি নেক আমল করা। বিশেষ করে আরাফার দিবস তথা জিলহজ মাসের নবম দিনে। কেননা দিনটি আল্লাহর নিকট অন্য দিনগুলোর তুলনায় অধিক প্রিয়। বছরের অন্য দিনের আমলের সওয়াবের চেয়ে এদিনের আমলের সওয়াব দ্বিগুণ। তেমনিভাবে এদিনের আমলের সওয়াব আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়কারীদের (মুজাহিদ) থেকেও উত্তম। সুতরাং দিনটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমাদের করণীয় হলো-
ক. একনিষ্ঠভাবে তওবা করে আল্লাহ দিকে ধাবিত হওয়া।
খ. সৎ কাজের প্রতি মনে আগ্রহ সৃষ্টি করা। যে কাজ করলে আমল কবুল হয় না, সেসব কাজ থেকে দূরে থাকা। অতীতের খারাপ কাজের জন্য জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করা।
আরাফার দিবসের আমল: এক. রোজা পালন করা। এটা এদিনের সর্বোত্তম আমল। সহিহ মুসলিম শরিফের এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘আরাফার দিবসের রোজা, পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। ’ তবে এ রোজা হাজিদের জন্য নয়, যারা হজে যায়নি- তাদের জন্য। হাজিদের জন্য আরাফার দিবসে রোজা রাখা মাকরুহ। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের সময় আরাফার দিবসে রোজা রাখেননি। বরং সবার সম্মুখে তিনি দুধ পান করেছেন। -মুসলিম
ইকরামা থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-এর বাড়িতে প্রবেশ করে আরাফার দিবসে আরাফার ময়দানে থাকা অবস্থায় রোজা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আরাফার ময়দানে আরাফার দিবসের রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। -মুসনাদে আহমদ: ২/৩০৪
দুই. তাকবিরে তাহরিমাসহ জামাতে নামাজ আদায় করা। বেশি বেশি সিজদা করা অর্থাৎ নফল নামাজ পড়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বেশি বেশি সিজদা করা তোমার দায়িত্ব। কেননা, তুমি যদি আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করো তাহলে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন, আর একটি গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। ’ –সহিহ মুসলিম: ৭৮৮
তিন. পুরুষের উচ্চ আওয়াজে একাকি তাকবির পাঠ করা। নারীরা নিম্নস্বরে তাকবির বলবে।
চার. আরাফার দিনে বেশি বেশি দোয়া পাঠ করা। আরাফার দিনের উত্তম দোয়া হলো, যেগুলো রাসূলুল্লাহ (সা.) ও পূর্ববর্তী নবীরা পাঠ করেছেন। ওই সব দোয়ার অন্যতম হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুওয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদির। ’
এ ছাড়া আরাফার দিনের দোয়াল আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার দোয়াও করা। আলেমরা ‘সুবহানাল্লাহ, ওয়াল হামদুলিল্লাহ, ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ বেশি বেশি পাঠ করার কথা বলেন।
পাঁচ. চোখ, কান ও জিহ্বাকে হারাম কাজ থেকে বিরত রাখা। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফার দিবসে যে তার কান, চোখ, জিহ্বাকে সঠিক কাজে ব্যয় করবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। ’ -শোয়াবুল ঈমান: ৩৭৬৬ ছয়. কোরআনে কারিম তেলাওয়াত করা। কোরআনের অর্থ ও তাফসির পাঠ করা।
সাত. হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা। আট. সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজ থেকে অন্যকে বিরত রাখা। আল্লাহতায়ালা সবাইকে আরাফার দিবসের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে বেশি বেশি নেক আমল সঠিকভাবে সম্পন্ন করার তওফিক দান করুন, আমিন।
হজ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সেতুবন্ধনের মাধ্যম। প্রতিটি সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর পবিত্র হজব্রত পালন করা ফরজ। কেউ হজ ফরজ হওয়ার পরও আদায় না করলে, বড় গুনাহগার হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) হাদিসে তাকে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করেছেন। হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত-মুস্তাহাব ও তালবিয়া ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
হজের ফরজ ৩টি: এক. ইহরাম বাঁধা। দুই. উ’কুফে আ’রাফা (বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা)। তিন. তাওয়াফুয জিয়ারাত।
হজের ওয়াজিব ৬টি: এক. ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড়গুলো মধ্যে ৭ বার সায়ি করা।
দুই. অকুফে মুযদালিফায় (৯ই জিলহজ) অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যদয় পর্যন্ত একমুহূর্তের জন্য হলেও অবস্থান করা। তিন. মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিক্ষেপ করা। চার. ‘হজে তামাত্তু’ ও ‘কিবরান’ কারীরা ‘হজ’ সমাপনের জন্য দমে শোকর করা। পাঁচ. ইহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল কাটা। ছয়. মক্কার বাইরের লোকদের জন্য তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কা থেকে বিদায়কালে তাওয়াফ করা।
ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ: ১. সেলাইযুক্ত যে কোনো কাপড় বা জুতা ব্যবহার, এক্ষেত্রে স্পঞ্জ সেন্ডেলের ব্যবহার করা। ২. মস্তক ও মুখমন্ডল (ইহরামের কাপড়সহ যে কোন কাপড় দ্বারা) ঢাকা। ৩. পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা। ৪. চুলকাটা বা ছিড়ে ফেলা। ৫. নখকাটা। ৬. ঘ্রাণযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো।
৭. স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক মিলন করা। ৮. যৌন উত্তেজনামূলক কোনো আচরণ বা কোনো কথা বলা। ৯. শিকার করা।
১০. ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ করা। ১১. চুল-দাড়িতে চিরুনী বা আঙ্গুলী চালনা করা, যাতে তা ছিঁড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। ১২. শরীরে সাবান লাগানো। ১৩. উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোনো জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা। ১৪. কোনো গুনাহের কাজ করা।