উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং দেশের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে চলমান বন্যায় দেশের ১৫ জেলা আক্রান্ত এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। গতকাল শনিবার (৬ জুলাই) সচিবালয়ে সাম্প্রতিক উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী এ কথা জানান।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রংপুর, জামালপুর, গাইবান্ধা, ফেনী, রাঙ্গামাটি, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট ও কক্সবাজার জেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
মহিবুবর রহমান আরও জানান, বন্যা আক্রান্ত ১৫ জেলায় এ পর্যন্ত নগদ তিন কোটি ১০ লাখ টাকা, ৮ হাজার ৭০০ টন ত্রাণের চাল, ৫৮ হাজার ৫০০ বস্তা শুকনো ব্যাগও অন্যান্য খাবার, শিশু খাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা এবং গো-খাদ্য কেনার জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিনই বন্যা বিস্তৃতি লাভ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। মহিববুর রহমান বলেন, পুরো ১৫ জেলায় মানুষ পানিবন্দী নয়। কোনো কোনো জেলা আংশিকভাবে বন্যা কবলিত। এখন পর্যন্ত আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৬ হাজার ২২৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এ বন্যায় এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। কেউ মারা যায়নি। এর মধ্যেই পানিবন্দী মানুষ রয়েছেন। প্রতিদিনই মানুষ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
বন্যা আক্রান্ত অ ল নিয়ে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন্যা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃতি লাভ করলে সেই জায়গাগুলোকেও আমরা এড্রেস করবো। বন্যার কারণে দক্ষিণ দিকেও প্লাবিত হতে পারে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী মাস (আগস্ট) কিংবা তার পরের মাসেও (সেপ্টেম্বর) এ রকম আরেকটা বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বন্যার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।
সবার সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি। তারপরও বিভিন্ন সময় পত্রিকায় দেখি যে কোনো কোনো জায়গায় খাদ্য পায়নি। এজন্য আমরা জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবো।
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য, ডিসি, ইউএনও-যখন যেটা চাচ্ছে আমরা দিচ্ছি। তারপরও গ্যাপ থাকার কোনো কারণ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মনে করি বন্যা দুর্গত এলাকায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত। টাঙ্গাইল এবং সিরাজগঞ্জের বন্যা সরেজমিনে দেখতে রোববার সেখানে যাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন মহিববুর রহমান।
জামালপুরে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি, ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা
আবুল কাশেম, জামালপুর:উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দেড় লাখ মানুষ। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, শনিবার (৬ জুলাই) বেলা ১১টায় দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় এক সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
প্রতিদিনই বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট। জামালপুরের ইসলামপুরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। উপজেলার দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সাতটি ইউনিয়নের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
পানি হু হু করে বৃদ্ধি পেয়ে ইসলামপুর উপজেলার সঙ্গে বানিয়াবাড়ী, দেলীরপাড়, গুঠাইল বাজার, আমতলী বাজার হতে ডেবরাইপ্যাচ, উলিয়া বাজার বামনা, শিংভাঙ্গা, উলিয়া, সোনামুখি, বেলগাছা, জারুলতলা, কুলকান্দি ও সদর ইউনিয়নের পচাবহলা, মলমগঞ্জ, শশারিয়াবাড়িসহ পশ্চিমা লের আটটি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে পৌর এলাকার নটারকান্দা সড়কসহ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ।
ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলী ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের রফিকুল ইসলাম, সুলতান মাহমুদ, আব্দুল করিম বলেন, হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বাজারে পানি ওঠায় বিরাট সমস্যায় পড়েছি। বড় কঠিন অবস্থায় মধ্যে আছি।
ইসলামপুরের চিনাডুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম জানান, পুরো ইউনিয়ন বন্যায় আক্রান্ত হয়ে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তাগুলো তলিয়ে গিয়েছে। বানভাসি মানুষ খুব কষ্টে দিন যাপন করছেন। রাতারাতি হঠাৎ পানি আসায় অনেকেরই জিনিসপত্র, হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে গেছে।
একই উপজেলার বেলগাছা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক জানান, পুরো ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি হয়ে অসহায় অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে।
ইসলামপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান টিটু জানান, বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় উপজেলার ৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫০টি মাধ্যমিক ও পাঁচটি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বন্যা আক্রান্তদের জন্য ১০৭টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। ১২০ মেট্রিক টন চাল ও শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিরাজুল ইসলাম জানান, প্লাবিত এলাকায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানশিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সব চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গ্রাম পুলিশদের সার্বক্ষণিক সতর্ক ও মেডিক্যাল টিমকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, বন্যার পানির কারণে জেলায় ১০৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বন্যাদুর্গতদের জন্য ১১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কয়েকশ পরিবার গবাদি পশু নিয়ে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। দুর্গতদের জন্য ৩০০ মেট্রিক টন চাল ও চার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ১১টি মেডিক্যাল টিম।