শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৫ অপরাহ্ন

ইসলামে মেহমানদারি

জাহিদ হাসান সিফাত
  • আপডেট সময় বুধবার, ১০ জুলাই, ২০২৪

ইসলামের অন্যতম শিষ্টাচার হলো মেহমানদারি করা। এটি ইসলামী সমাজের অন্যতম সৌহার্দ্য। মেহমানদারির মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা, সৌহার্দ্য ও সম্মানবোধ তৈরি হয়। এটি উদারতা ও উন্নত মানসিকতার সর্বোচ্চ পরিচায়ক। ইসলামে মেহমানদারিকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মেহমানদারির বিধান : অধিকাংশ ইমাম ও বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী, মেহমানদারি হলো একটি ইসলামী শিষ্টাচার ও সুন্নত। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।’ (বুখারি-৬১৩৮) এটিকে ইবরাহিম আ:-এর সুন্নতও বলা হয়। কারণ তিনিই পৃথিবীতে প্রথম মেহমানদারির প্রচলন করেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআন কারিমে তার মেহমাননেওয়াজ গুণের প্রশংসা করে বলেন- ‘আপনার কাছে কি ইবরাহিম আ: সম্মানিত মেহমানদের সংবাদ এসেছে? যখন তার কাছে এসেছে তারা একসাথে সালাম দিয়েছে। তিনি বললেন, তোমাদের প্রতিও সালাম। তোমরা তো অপরিচিত। তখন তিনি সাথে সাথে তার পরিবারের কাছে গেলেন এবং একটি গরুর বাছুর ভুনা করে নিয়ে এলেন।’ (সূরা জারিয়াত-২৪)
মেহমানদারির ফজিলত : মেহমানদারির অনেক ফজিলত রয়েছে। রাসূল সা: কখনো কোনো মেহমানকে ফিরিয়ে দিতেন না। চাই সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম। নিজের কাছে মেহমানদারি কারানোর মতো কিছু না থাকলে সাহাবায়ে কেরামের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। সাহাবায়ে কেরামও মেহমানদারিকে এত গুরুত্ব দিতেন কখনো কখনো নিজেরা না খেয়ে মেহমানকে খাওয়াতেন। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- একজন সাহাবি রাসূল সা: মেহমান নিয়ে বাড়িতে এলেন। কিন্তু ঘরে বাচ্চার জন্য রাতের সামান্য খাবার ছাড়া আর কিছু ছিল না। তাই বাচ্চার খাবার দিয়েই মেহমানদারি করিয়েছেন। অপর দিকে, তার পরিবার ও বাচ্চা ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই রাত কাটাল। পরদিন যখন তিনি রাসূল সা:-এর কাছে এলেন তখন তিনি তাদের বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা গত রাতে তোমাদের কাজ (মেহমানের জন্য ত্যাগ) দেখে হেসে দিয়েছেন।’ (বুখারি-৩৭৯৮) মেহমানের জন্য তাদের এই ত্যাগে আল্লাহ খুশি হয়ে কুরআনের আয়াত নাজিল করলেন- ‘তাদের অভাব অনটন ও পেটে ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদের চেয়ে মেহমানকে অগ্রাধিকার দেয়।’ (সূরা হাশর-৯) উপরোক্ত হাদিস থেকে এটাও বুঝা যায় যে, মেহমানদারির মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা খুশি হন।
হাদিসে মেহমানদারির কথা অনেক গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে এর ফাজায়েল। যেমন- মেহমানদারি বরকতের কারণ হয়। রাসূল সা: বলেন, ‘মেহমানদারিতে দুজনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট হয়। তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট হয়।’ (বুখারি-৫৩৯২) তবে এটি হবে যখন নিয়ত খালেছ থাকবে। খাবার হবে হালাল এবং মেহমানদারি হবে আল্লাহর জন্য শরিয়তসম্মত উপায়ে। মেহমানদারির মাধ্যমে জান্নাত লাভ হয়। আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘হে লোকেরা! তোমরা সালামের প্রচার প্রসার করো। লোকদের মেহমানদারি করো এবং যখন মানুষ গভীর রজনীতে সুখনিদ্রায় থাকে তখন প্রভুর দরবারে নামাজে দাঁড়াও। তাহলে তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে।’ (তিরমিজি-২৪৮৫) এ ছাড়াও মেহমানদারির কারণে দুনিয়াতে মিলে সম্মান। মানুষের মধ্যে তৈরি হয় ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য।

মেহমানদারির আদব : মেহমানদারি একটি মহান কাজ। উত্তম আখলাক ও সর্বোচ্চ সম্ভ্রান্ততার পরিচায়ক। তবে সেটির সাথে যদি যোগ হয় আরো কিছু উত্তম শিষ্টাচার তাহলে তা হবে নববী মেহমানদারি। কুরআনে কারিম ও হাদিসে মেহমানদারির বিভিন্ন আদব বর্ণিত হয়েছে।
১. মেহমানকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে অভিবাদন জানিয়ে বরণ করে নেয়া। রাসূল সা:-এর কাছে যখন ওয়াফদে আবদে কাইস এসেছিল তখন তিনি বলেছিলেন, ‘সসম্মানে আপনাদের সুস্বাগতম’ (বুখারি-৫৩)
২. মেহমানের সামনে দ্রুত খাবার পরিবেশন করা। কুরআন কারিমে ইবরাহিম আ:-এর এই গুণের প্রশংসা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন- ‘যখন আমার দূতগণ ইবরাহিমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে গেল তখন তারা বলল, আপনার প্রতি সালাম। তিনিও বললেন, তোমাদেরকেও সালাম। এরপর তিনি অপেক্ষা না করে তাৎক্ষণিক একটি গরুর বাছুর ভুনা করে নিয়ে এলেন।’ (সূরা হুদ-৬৯)
৩. লোক দেখানোর জন্য খাবার আড়ম্বরপূর্ণ না করা। হজরত আনাস রা: বলেন, ‘আমরা ওমর রা:-এর কাছে বসেছিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘আমাদেরকে খাবারের আড়ম্বরপূর্ণতা থেকে নিষেধ করা হয়েছে।’ (বুখারি-৭২৯৩)
৪. মেহমানের জন্য করণীয় হলো খাবার খেয়ে অবস্থানুপাতে দ্রুত উঠে যাওয়া। কারণ কখনো কখনো মেহমানের দীর্ঘক্ষণ অবস্থান মেজবানের জন্য কষ্টকর হয়। কুরআনে নির্দেশ এসেছে, ‘যখন তোমাদেরকে নবীজির ঘরে দাওয়াত দেয়া হবে তখন তোমরা ঘরে যাবে এবং খাবার খেয়ে নিজেদের কাজে বেরিয়ে পড়বে। অযথা আলাপচারিতায় লিপ্ত হবে না। কারণ এটি নবী সা:-কে কষ্ট দেয়। কিন্তু তিনি বলতে লজ্জা পান। আল্লাহ সত্য প্রকাশে লজ্জা করেন না।’ (সূরা আহজাব-৫৩)

এ ছাড়াও রয়েছে আরো বহু আদব। রয়েছে স্থানকালপাত্রের অনেক আবেদন। তাই আমাদেরকে সেগুলোর ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
মেহমানদারির সামাজিক ত্রুটি : মেহমানদারি করানো যেমন উদার মনন ও উন্নত চরিত্রের পরিচায়ক, তেমনিভাবে মেহমানদারি নিয়ে মেজবানকে কষ্ট দেয়া ও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দাওয়াতের আশা ব্যক্ত করে নানা হাঙ্গামা তৈরি করা নিকৃষ্টতম চরিত্রের আলামত। ছোট মানসিকতা। কিন্তু বর্তমান সমাজে এই রোগ ব্যাপকভাবে হয়ে আছে। আত্মীয়-অনাত্মীয়ের বাড়িতে কারণে-অকারণে দাওয়াতকে অধিকার মনে করা হয়। দাওয়াত না পাওয়াকে নিজেদের জন্য চরম লজ্জার বিষয় ভাবা হয়। কিন্তু ইসলামে এমন কিছুর বাস্তবতা নেই; বরং এটি একটি ঘৃণ্য কাজ। ইসলামে দাওয়াত একটি ঐচ্ছিক ইবাদত। রাসূল সা: ও সাহাবায়ে কেরামের জমানায় দাওয়াত পাওয়া বা না পাওয়াকে তারা কখনো গণনায় রাখতেন না। এ নিয়ে তাদের ছিল না কোনো দুঃখ; বরং সবাই চেষ্টা করতেন দাওয়াত গ্রহণের পরিবর্তে অপর ভাইকে দাওয়াত দিতে। যেমন- জাবের রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘রাসূল সা: আমাকে বললেন, তুমি কি বিয়ে করেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ! রাসূল সা: জিজ্ঞেস করলেন, কুমারী নাকি বিবাহিতা নারী? আমি বললাম, বিবাহিতা নারী। রাসূল সা: বললেন, কুমারী মেয়ে বিয়ে করোনি কেন? তাহলে তুমি তার সাথে অধিক খেলতামাশা করতে। সেও তোমার সাথে খেলতামাশা করত।’ (বুখারি-৫২৪৭)
একটু গভীর চিন্তার বিষয়। সাহাবায়ে কেরাম রাসূলের কথা ছাড়া সামান্য উঠাবসাও করতেন না। সেখানে জাবের রা: বিয়ে করলেন। কিন্তু রাসূল সা: জানলেন না। তার মানে বিয়ে এবং এই উপলক্ষে দাওয়াত এসব ছিল এতটাই সাধারণ যে জানানোর তেমন প্রয়োজনই ছিল না। অনুরূপভাবে রাসূল সা:ও তাতে মনঃক্ষুণœ হননি। এটিকে সাধারণভাবেই নিয়েছেন। তা ছাড়া হাসির ছলে তাকে একটি সুন্দর উপদেশ দিয়েছেন। অথচ আমাদের বর্তমান সমাজে দাওয়াতকে কেন্দ্র করে ঘটে তুলকালাম কা-। এর কারণে হয় নানা জুলুম। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। যেগুলো চরম ছোট মানসিকতার পরিচায়ক। ইসলামে তা সুস্পষ্ট হারাম। কুরআনে কারিম ও হাদিসে এসব বিষয়ে অনেক মারাত্মক শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। তাই আমাদের এসব থেকে বেঁচে থাকা উচিত।
দাওয়াত ইসলামের একটি উত্তম আমল। সামাজিক দৃষ্টিতেও এটি উন্নত মানসিকতা ও আভিজাত্যের পরিচায়ক। তবে এটিতে আমাদের ভারসাম্য রক্ষা করা উচিত। ভারসাম্য ছাড়া এটি একটি ঘৃণ্য প্রথাতে রূপান্তরিত হয়। সমাজে হয় বিশৃঙ্খলা। সৌহার্দ্য ও সম্পর্ক গড়ার পরিবর্তে তৈরি হয় একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ, শত্রুতা।
লেখক : ছাত্র, তাকমিল জামাত, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com