স্বামী স্ত্রীর ওপর কর্তৃত্বশীল যেমন রবের ঘোষণা, অন্যের প্রতি অত্যাচার না করাও তেমনি রবের আদেশ। ইসলাম স্বামীর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার সাথে সাথে স্ত্রীর প্রতি ইনসাফ নিশ্চিত করেছে। স্ত্রীর প্রতি অন্যায়, জুলুম, অবিচার রোধে নবীজী সা: বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন। তোমরা নারীদের সাথে সদাচরণ করো। (বুখারি : ৩৩৩১) অনেক ক্ষেত্রে নারীরা স্বামীগৃহে অত্যাচারের শিকার হয়। অবিবেচক স্বামী ও তার পরিবার কর্তৃক নিগ্রহের শিকার হয়। সমাজে প্রচলিত এমন কিছু রীতিনীতি আছে, যেগুলোকে স্বামী নিজের অধিকার মনে করে স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দেয়। আদতে তা অধিকারের নামে অত্যাচার বৈ কিছু নয়, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযতœ করা : বড়দের সেবা-শুশ্রƒষা ও আদর আপ্যায়ন করা সৌভাগ্যের আলামত, বরকতের কারণ। নবীজী বলেছেন, যারা বড়দের সম্মান ও আদর আপ্যায়ন করে না তারা আমার উম্মত না। (তিরমিজি : ১৯২১) সেই সূত্রে শ্বশুর-শাশুড়ি সেবাযতœ পাওয়ার অধিকার রাখে। তাদের সেবা-শুশ্রƒষা করা সৌভাগ্য ও পুণ্যের বিষয়। সেই সৌভাগ্য প্রত্যেক বউয়ের অর্জন করা উচিত। কিন্তু ইচ্ছানির্ভর এই বিষয়টাকে স্ত্রীর ওপর অত্যাবশ্যকীয়ভাবে চাপিয়ে দেয়া নিশ্চয়ই জুলুম এবং গর্হিত কাজ। তাদের সেবা-শুশ্রƒষা পাওয়াকে আবশ্যকীয় অধিকার মনে করা অত্যাচার ও অবিচার বৈ কিছু না। (ইসলাহি খুতুবাত ২ : ৪৩)
পারিবারিক কাজের বোঝা : স্ত্রীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সবকিছুর দায়িত্ব স্বামীর। যেমনটা সূরা তালাকে বর্ণিত হয়েছে, তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঘরে তাদেরকে বসবাস করাও। বিত্তশীল ব্যক্তি স্বীয় বিত্তানুযায়ী ব্যয় করবে। সীমিত রিজিকপ্রাপ্ত ব্যক্তি আল্লাহ যা দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করবে। (৬, ৭) পারিবারিক কাজ সামলানো স্ত্রীর অবশ্যকীয় দায়িত্ব নয়। তবে পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহ করতে কুরআন উৎসাহিত করেছে। যেমনটা সূরা কাসাসে বর্ণিত হয়েছে, তুমি অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। নিশ্চয় আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে ভালোবাসেন না। (৭৭) তাই, স্ত্রী স্বামীর প্রতি অনুগ্রহপূর্বক পারিবারিক কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। স্বামীদের উচিত এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এই অনুগ্রহকে আবশ্যকীয় দায়িত্ব হিসেবে তাদের কাঁধে চাপানো উচিত নয়। (ইসলাহি খুতুবাত ২:৪৩)
দেবর-ননদের তত্ত্বাবধান : বর্তমান সমাজের অধিকাংশ পরিবারে এই দৃশ্য হরহামেশা দেখা যায় যে, স্বামীর ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব বড় ভাইয়ের স্ত্রীর কাঁধে চাপানো হয়। তাদের জন্য খাবার রান্নাবান্না ও পরিবেশন ইত্যাদি বউয়ের দায়িত্বে অর্পণ করা হয়। এতে পর্দার বিধান বিঘিœত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি কিি ৎ অবহেলা বা পদস্খলন হলে অনেকসময় বউকে দৈহিক বা মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়। এমন আচরণ করা হয়, যেন সে ফরজ কোনো দায়িত্বে অবহেলা করেছে। অথচ এগুলো তার দায়িত্বে বর্তায় না। যেখানে ইসলাম শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযতœ করাকে আবশ্যকীয় করেনি। এমনকি সন্তানের জন্যও জননীকে কষ্ট দিতে বারণ করে বলা হয়েছে, আর মাতাকে কষ্ট দেয়া যাবে না তার সন্তানের কারণে। (সূরা বাকারাহ : ২৩৩) সেখানে দেবর-ননদের জন্য স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া কতটুকু বৈধতা রাখে? এটা অধিকারের অন্তরালে মহাজুলুম নয় তা আর কী?
মোহরানা ক্ষমা চাওয়া : মোহর স্ত্রীর অধিকার, যা ইসলাম তাকে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা যথাযথভাবে তাদের মোহর আদায় করো। (সূরা নিসা : ২৫) স্বামীদের উচিত কোনো ধরনের টালবাহানা না করে তা পরিশোধ করা। মোহর পরিশোধ না করে, বাসর রাতে কিংবা মৃত্যুর সময় অথবা জানাজার আগ মুহূর্তে অন্যের মাধ্যমে স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়া বড্ড লজ্জাকর বিষয়। কাউকে ক্ষমা করা মহৎ গুণ। প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে ক্ষমার গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়; কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে লজ্জার মুখোমুখি করে ক্ষমা নেয়া, লোক-লজ্জার সামনে ক্ষমা করতে বাধ্য করা ভদ্রলোকের কাজ নয়। এমন ক্ষমা আদৌ গ্রহণ হবে কি না, সেটিও ভাবনার বিষয়। কিন্তু আমাদের সমাজে অধিকাংশ স্বামী লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে এই কাজটি করে। এটাকে নিজের অধিকার ভাবেন এবং মনে করেন, ক্ষমা চাইলেই লেঠা সাফ। ক্ষমা না করলেও সমাজের লোকেরা খারাপ চোখে দেখে। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে স্ত্রী ক্ষমার ঘোষণা করে। এ ধরনের কাজ নিশ্চয়ই অনৈতিক।
মিরাস থেকে বি ত করা: ইসলামিক বিধান মতে স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রী উত্তারাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পায়; কিন্তু অনেক স্বামী অবিবেচকের মতো স্ত্রীদেরকে ন্যায্য পাওনা থেকে বি ত করেন। মৃত্যুর আগমুহূর্তে সন্তানদের নামে সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে দেয়া হলেও স্ত্রীর নামে কিছুই দেয়া হয় না। বলা হয় তোমার ছেলেমেয়েদেরকেই তো দেয়া হচ্ছে! এমনটা হওয়া উচিত নয়। একজন অবিবেচক স্বামীই, স্ত্রীর সাথে এমনটা করতে পারে।
স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামীর জোরদখল: একজন মেয়ে তার বাবার সম্পত্তিতে যে অংশ পায় তার মালিক সে নিজে। তার সম্পত্তি সে কোন খাতে ব্যয় করবে এই ইচ্ছাধিকার তার একান্ত। সেখান থেকে স্বামীকে দিতেও পারে, নাও দিতে পারে। এই সম্পত্তি স্বামীকে দিতে সে বাধ্য নয়; কিন্তু আমাদের সমাজের চিত্র ভিন্ন। প্রথমত, স্ত্রীকে বাবার সম্পত্তির অংশ নিয়ে আসতে বাধ্য করা হয়। দ্বিতীয়ত, সেটি স্বামী নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করে। স্ত্রীর সামান্য মতামত নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করে না। অথচ এর প্রকৃত মালিক কিন্তু স্ত্রী-ই। এটা অন্যের সম্পত্তিতে অনধিকার প্রবেশ এবং অন্যের অধিকার হরণের নামান্তর, যার দ্বারা অন্যের হক বিনষ্ট হয়, যা ব্যক্তির অনুমতি ব্যতীত আল্লাহ মাফ করবেন না।
স্ত্রীর অধিকার আদায়ে উদাসীনতা:ইসলাম স্বামীকে একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে। তবে শর্ত হলো, প্রত্যেকের প্রতি ইনসাফ করতে হবে। কারো প্রতি কোনো অন্যায়-অবিচার করা যাবে না। নবীজী বলেছেন, যার দুই স্ত্রী থাকবে এবং সে যদি একজনকে অন্যজনের ওপর প্রাধান্য দেয়, তাহলে সে কেয়ামতে উত্থিত হবে এক পার্শ্ব কাত অবস্থায়। (আবু দাউদ :২১৩৩) সূরা বাকারায় স্ত্রীদের অধিকার বর্ণনা শেষে আল্লাহ বলেছেন, এগুলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কাজেই একে অতিক্রম করো না। বস্তুত যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে, তারাই জালেম। (২২৯) বর্তমান সমাজ স্ত্রীর অধিকারের প্রতি কোনো ভ্রƒক্ষেপেই করা হয় না। তাদের ন্যায্য পাওনাগুলো দিতে উৎসাহী হতে দেখা যায় না। ইসলাম কর্তৃক প্রদত্ত অধিকার প্রদানে উদাসীন থাকেন এবং এটাকে তারা ন্যায্য বলেই ভাবেন। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের মানসিকতা সম্পূর্ণ অনৈসলামিক।
অনর্থক কষ্ট দেয়া হারাম:স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে সঙ্কট দেখা দিতে পারে। নবীজীর দাম্পত্য জীবনেও এমন মান-অভিমানের ঘটনা ঘটেছে। আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে সেসবের মীমাংসা হয়েছে। রাগ-গোস্বাকে কেন্দ্র করে তিনি কখনো স্ত্রীদেরকে কষ্ট দেননি। আঘাত পৌঁছাননি। প্রহারের মতো নির্মমতা প্রদর্শন করেননি। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: বলেন, নবীজী কখনো তার স্ত্রীদের প্রহার করেননি (মুসলিম : ২৩২৮) কিন্তু আমাদের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন, কোনো কোনো ব্যক্তি স্ত্রীকে পশুর মতো প্রহার করে। চলনে-বলনে আঘাত পৌঁছায়, যা ঘোর অন্যায়। নবীজী বলেছেন, স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা তোমরা আল্লাহর আমানত হিসেবে তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর নামে তাদেরকে নিজেদের জন্য হালাল করেছ। (মুসলিম : ১২১৮)
লেখক : খতিব-বায়তুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর