জুলুম একটি সামাজিক ব্যাধি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গ-ি ছাড়িয়ে পৃথিবীজুড়ে চলছে জুলুমের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। চারদিকে প্রকাশ পাচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী এই জুলুমে লিপ্ত। জুলুম একটি মারাত্মক কবিরা গোনাহ। যার পরিণতি মন্দ ও ভয়াবহ। অন্যের ওপর অন্যায়-অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। মানুষের বিভিন্ন বিপদ-আপদে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ জুলুম।
জালিম যখন দুর্বলের প্রতি অত্যাচার চালায়, তখন সে মনে করে সে অনেক ক্ষমতাবান। তার অর্থবিত্ত, শক্তি ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী। কিন্তু সে ভুলে যায়, ওই অসহায় লোকটির পক্ষে কেউ না থাকলেও মহান আল্লাহ সবই দেখেন ও হিসাব রাখেন। পৃথিবীত জালেমের অন্যায়-অত্যাচার আর অবৈধ শক্তির ভয়ে মানুষ আতঙ্কিত ও ভীত থাকে। অনেক অসহায় প্রাণ দুই হাত তুলে জালেমের ধ্বংস প্রার্থনা করেন। আর মজলুমের বদদোয়া আল্লাহ কখনো ফিরিয়ে দেন না। আজ যে জালেম নিজেকে শক্তিশালী অনুভব করে এবং শক্তির দাপটে দুর্বলের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না, কাল কেয়ামতের দিন সে নিজেকে মারাত্মক দুর্বল ও দরিদ্র অনুভব করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জালিমদের কোনো বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে।’ -সুরা মুমিন : ১৮
জুলুম এক অমার্জনীয় অপরাধ, এর শাস্তি অনিবার্য ও ভয়াবহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কখনো মনে করো না যে, জালিমরা যা করছে সে বিষয়ে মহান আল্লাহ উদাসীন। আসলে তিনি সেদিন পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন, যেদিন সব চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। ভীত-বিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছুটাছুটি করবে, আতঙ্কে তাদের নিজেদের দিকেও ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (ভয়ানক) উদাস। সেদিন সম্পর্কে তুমি মানুষকে সতর্ক করো যেদিন তাদের শাস্তি আসবে, যেদিন জালিমরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কিছু কালের জন্য অবকাশ দাও, আমরা তোমার আহ্বানে সাড়া দেব এবং রাসুলদের অনুসরণ করব। (তখন তাদের বলা হবে,) তোমরা কি পূর্বে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের কোনো পতন নেই?’ -সুরা ইবরাহিম : ৪২-৪৪
পবিত্র কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি জালিমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে, তারা পানীয় চাইলে তাদের দেওয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানীয়, যা তাদের মুখম-ল দগ্ধ করবে, এটি কত নিকৃষ্ট পানীয়, জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়।’ -সুরা কাহফ : ২৯
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের সতর্ক করে দাও আসন্ন দিন (কেয়ামত) সম্পর্কে যখন দুঃখকষ্টে তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে। জালিমদের জন্য কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই এবং যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে এমন কোনো সুপারিশকারীও নেই।’ -সুরা মুমিন : ১৮
এভাবে কোরআন মাজিদের অনেক আয়াত রয়েছে, যাতে জালিমের কঠিন শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ জালিমকে ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেবেন না। জালিমকে তার জুলুমের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে, মজলুমের কাছে মাফ চেয়ে মাফ করানো ছাড়া এ শাস্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহতায়ালা ইহকালে দিয়ে থাকেন। জালিমের বিচার শুধু কিয়ামতের দিবসেই হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহতায়ালা তাদের জুলুমের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেন। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহতায়ালা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’ -জামে তিরমিজি : ২৫১১
মজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ জালিমের পতনের অন্যতম কারণ। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ -জামে তিরমিজি : ৩৫৯৮ হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, ‘মজলুমের বদদোয়াকে ভয় করো, কেননা মজলুমের বদদোয়া ও আল্লাহর মধ্যে কোনো অন্তরাল নেই।’ -সহিহ বোখারি : ২২৮৬) । অর্থাৎ মজলুমের দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়।
শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের জন্য ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত থাকা শর্ত। যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি জুলুম করে সে কেবল অন্যেরই ক্ষতি করে না, নিজ জীবনের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলে। আর সমাজের অধিকাংশ লোকেরই যখন চরিত্র হয় জুলুমবাজি অর্থাৎ যারা পারস্পরিক হক আদায়ের কোনো তোয়াক্কা করে না, সেই সমাজ দুর্যোগকবলিত হবেই। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আমার (নবীর) কথা শোনো, তা হলে বেঁচে থাকতে পারবে, সাবধান! তোমরা জুলুম করো না। সাবধান তোমরা জুলুম করো না। সাবধান তোমরা জুলুম করো না!’ -মুসনাদে আহমাদ : ২০৬৯৫
আল্লাহতায়ালা নিজের জন্য জুলুম হারাম করেছেন, তেমনি বান্দাদের জন্য জুলুমকে হারাম করেছেন। হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার বান্দারা! আমি জুলুম করাকে নিজের প্রতি হারাম করেছি এবং তাকে তোমাদের মধ্যেও হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং পরস্পর পরস্পরের প্রতি জুলুম করো না।’ -সহিহ মুসলিম : ২৫৭৭
যারা জুলুম করে এমন কাউকে মহান আল্লাহ অতীতে ছাড় দেননি, তার শেকড় যতই শক্ত হোক। ফেরাউন ও নমরুদ তাদের শক্তির দাম্ভিকতায় নিজেদের রব বলে দাবি করেছে। স্বীয় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এবং তার পথের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের সব নবজাতক ছেলেসন্তানদের হত্যা করেছে। কিন্তু এতকিছুর পরও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ জালেমকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। পরিশেষে যখন ধরেন তখন আর ছাড়েন না।’ -সহিহ বোখারি : ৪৬৮৬) ।
দুনিয়ায় যুগে যুগে নবী-রাসুল প্রেরণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে, পৃথিবী থেকে যাবতীয় জুলুম-অত্যাচারের পরিসমাপ্তি ঘটানো। মানবজাতির প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক নিয়মনীতির ওপর প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য ইসলাম সবক্ষেত্রে জুলুম-অবিচার থেকে দূরে থাকার জন্য গুরুত্বারোপ করেছে।