চারদিকে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। তাই কৃষিতেও পরিবর্তন জরুরি। শৈশবে দেখেছি—গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরের গোলায় শস্যের কমতি ছিল না। বলা হতো—গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, মাঠ ভরা ফসল—এই তো আমাদের গ্রামের চিরায়ত রূপ। সেই রূপ এখন কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক জীবনযাপনের অজুহাতে কৃষিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে গ্রামের মানুষও। তাই হয়তো ভয়ংকর দুঃসময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
আমার মনে হয়, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হলে আমাদের কৃষিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষিখাতকে উৎপাদনমুখী করতে হবে। ধরা যাক, আপনার কাছে প্রচুর টাকা আছে, অথচ বাজারে কোনো খাদ্যপণ্য নেই। কী হবে আপনার সেই প্রচুর টাকা দিয়ে? ওইসব টাকা দিয়ে কী কিনে খাবেন আপনি? এভাবেই যদি আমাদের গ্রামের সবাই প্রবাসে যান, তারা হয়তো প্রচুর ডলার কামাতে পারবেন। জমি চাষ করার লোক না থাকলে সেই ডলার দিয়ে আপনার পরিবার কী কিনবেন?
জীবনমুখী গল্পকার সুবোধ ঘোষের ‘তমসাবৃতা’ গল্পে চাষিরা তাদের সব পণ্য একবার দ্বিগুণ দামে গঞ্জে বিক্রি করে দেয়। ফলে গঞ্জের মহাজনও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে তিন মাসের মধ্যে তাদের জমানো সব টাকা শেষ হয়ে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তাদের পরনের কাপড়ও জোটে না। তাদের আরও সাত মাস অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী ফসলের জন্য। ফসল ফলিয়েও অভুক্ত থাকতে হয়েছে শুধু নিজেদের ভুলে। ফলে রাতের অন্ধকারে ঘরের নারীরা নগ্ন দেহে জমিতে কাজ করেছে। সূর্য ওঠার আগে পৃথিবী অন্ধকার থাকতেই ঘরে ফিরতে হয়েছে। অভাবে পড়েই তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ভুল শুধরে নেওয়ার উপায় খুঁজেছেন।
আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজের জমিতে ধান, পাট, আখ, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, টমেটো, তিল, তিসি, শাক-সবজি চাষ করতেন। জমির পরিচর্যা করতেন। সময় পেলেই জমিতে কাজ করতেন। নিজের উৎপাদিত শস্যেই তাদের বছর পার হয়ে যেত। আবার উদ্বৃত্ত শস্য বাজারে বিক্রিও করতেন। বাড়িতে ফল গাছও ছিল প্রচুর। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, গাব, জাম—কোনো কিছুর কমতি ছিল না। মাছ-মাংস ছাড়া তেমন কিছু বাজার থেকে কিনতে হতো না। কিন্তু আমরা পরবর্তী প্রজন্ম কৃষি থেকে সরে গেছি। শহরমুখী হয়েছি। উচ্চশিক্ষিত হয়েছি। এখন সবকিছুই কিনে খেতে হয়। ফলে চাকরি করেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আমার বাবা শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন। বর্ষায় মাছ ধরতেন। ভালো জাল বুনতেন। আমাদের চাল-ডাল তেমন কিনে খেতে হতো না। মাকে দেখতাম, বাড়ির খালি জায়গায় শাক-সবজির চাষ করতেন। এখনো করেন। স্বল্প পরিসরে টিকিয়ে রেখেছেন। জনবল সংকটের কারণে আগের মতো পারেন না। এদিকে এখন আমরা যারা শহরে থাকি, এসব বাজার থেকেই কিনে খাই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাই। মাসের অর্ধেক যেতেই মানিব্যাগ খালি হয়ে যায়। অথচ এখনো গ্রামের মানুষ চাইলেই নিজের জমিতে উৎপাদিত ফসল দিয়ে একবছর ভালোই চলতে পারেন। কিন্তু গ্রামেও নাগরিক ছোঁয়া চলে গেছে। কেউ কেউ কৃষিকাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কাজের লোক পাওয়া যায় না। বদলা-কামলার পেশাকে ঘৃণা করছেন। সবাই ছুটছেন শহরে কিংবা বিদেশে। একসময় তারাও হয়তো ফিরে এসে আফসোস করবেন। অতীতের জন্য হতাশ হবেন। কেননা কংক্রিটের মাঝে অর্থ ফলে, শস্য ফলে না।
তবে আনন্দ সংবাদ হচ্ছে, এখন শিক্ষিত যুবকরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আমাদের কৃষিতে অবদান রাখছেন। আশা করি একদিন হয়তো কৃষকের সংখ্যা বেড়ে বেকারের সংখ্যা কমে যাবে। অনেক সিনেমায় দেখি, কৃষিকে তারা কীভাবে গুরুত্ব দেন। শস্যকে তারা প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। এসব সিনেমার মধ্য দিয়ে তারা কৃষিকে সম্মানিত করেন। অন্যকেও অনুপ্রাণিত করেন।
সংকট তো মানুষই সৃষ্টি করে। আবার মানুষই সংকট নিরসন করে। শুধু দরকার একটু আন্তরিক প্রচেষ্টা। পৃথিবী তো উদার। প্রতিনিয়তই আমাদের দান করে যাচ্ছে। কিন্তু তার জন্য তো পরিচর্যা দরকার। আমরা পৃথিবীকে অবহেলা করছি। সবাই জানি, শিক্ষাজীবনে ভালোভাবে পড়লে ভালো ফলাফল পাবেন। কিন্তু জমিতে ভালোভাবে চাষ না করলে ভালো শস্য পাবেন কীভাবে? তাই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষিত কৃষকও সৃষ্টি করা জরুরি। কৃষিকাজ কোনো নিন্দিত কাজ নয়। বরং কৃষিও বৃহৎ শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। অন্য শিল্পেও পরিশ্রম করতে হয়। এখানেও পরিশ্রম করতে হবে। কাদা-জল মাখায় কোনো লজ্জা নেই। বরং গর্ব আছে। দেশকে ভালোবাসার অহংকার আছে। তাই সরকারকেও কৃষিতে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতি বছর কৃষকদের প্রণোদনা দিতে হবে। সফল কৃষকদের পুরস্কৃত করতে হবে। কৃষি অফিস সরেজমিনে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেবে। বীজ-সার দিয়ে সাহায্য করবে।
সৃষ্টিকর্তা আমাদের জমি দিয়েছেন আবাদ করার জন্য। তাই আমাদের ফসলি জমি বাড়ানো উচিত। সব ধরনের জমি কৃষির আওতায় আনা উচিত। হোক শস্য কিংবা শাক-সবজি। কৃষিপণ্য কিনে আনার চেয়ে নিজে উৎপাদন করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কৃষিও হতে পারে একটি দেশের প্রধান শিল্প। শুধু দরকার আমাদের উন্নত মানসিকতা। দরকার ইতিবাচক ভূমিকা। সব ধরনের দুর্গতি দূর হোক। ফুল, ফল, ফসলে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ।