মহা মহীয়ান অসীম দয়াবান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান করা জ্ঞানের আলোয় মুমিন বান্দারা দুনিয়ার কণ্টকাকীর্ণ পথে সতত সামনে অগ্রসর হয়। তাঁর দেখানো জ্যোতির্ময় নির্দেশনায় একপর্যায়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। হাজারো প্রতিকূলতা পেরিয়ে আল্লাহর সাহায্যেই প্রত্যাশিত বিজয় অর্জন করে। তাই মানুষ নয়; আল্লাহ তায়ালাকেই ভয় করতে হবে এবং ইবাদত-উপাসনা-আরাধনা একমাত্র তারই প্রাপ্য। আল্লাহর হাতেই সব ক্ষমতা। তিনি সম্মান দান করেন আবার তিনিই তা কেড়ে নেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন মাজিদে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন- ‘(হে নবী), তুমি বলো, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ), তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে রাজ্য দান করো, আবার যার কাছ থেকে চাও তা কেড়েও নিয়ে যাও, যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত করো, যাকে ইচ্ছা তুমি অপমানিত করো; সব রকমের কল্যাণ তো তোমার হাতেই নিবদ্ধ; নিশ্চয়ই তুমি সবকিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান।
তুমিই রাতকে দিনের মাঝে শামিল করো, আবার দিনকে রাতের ভেতর শামিল করো; প্রাণহীন (বস্তু) থেকে তুমি (যেমন) প্রাণের আবির্ভাব ঘটাও, (আবার) প্রাণহীন (অসাড়) বস্তু বের করে আনো প্রাণসর্বস্ব (জীব) থেকে এবং যাকে ইচ্ছা তুমি বিনা হিসাবে রিজিক দান করো।’ (সূরা আলে-ইমরান : ২৬-২৭)
উল্লিখিত আয়াতে কারিমার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রাসূল সা:-কে এবং প্রত্যেক মুমিনকে বিশ্ব-প্রকৃতিতে ও মানবজীবনে আল্লাহর একক ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের কথা স্মরণ করার শিক্ষা দিয়েছেন। কেননা, আল্লাহর একত্ব ও একাধিপতিত্ব- এই দুটো জিনিসই আল্লাহর অংশীদারবিহীন ইলাহ হওয়া ও সার্বভৌমত্বের মূল কথা। ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে কিভাবে এই শিক্ষা দেয়া হয়েছে লক্ষ করুন- ‘বলো, হে আল্লাহ তায়ালা, হে বিশ্ব-সাম্রাজ্যের সার্বভৌম অধিপতি, তুমি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করে থাকো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব কেড়ে নাও, যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করো এবং যাকে ইচ্ছা অপমানিত করো। যাবতীয় মঙ্গল ও কল্যাণ কেবল তোমারই হাতে। নিশ্চয়ই তুমি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান; তুমি রাতকে দিনের এবং দিনকে রাতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাও আর জীবিতকে মৃত থেকে এবং মৃতকে জীবিত থেকে বের করে আনো। আর তুমি যাকে চাও বিনা হিসাবে জীবিকা দাও।’
আয়াত দু’টির শাব্দিক বিন্যাসে রয়েছে প্রার্থনার ভাবধারা আর মর্মার্থে রয়েছে আত্মনিবেদনের মনোভাব। আর এতে এই উন্মুক্ত প্রকৃতির প্রতি যে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে তাতে রয়েছে আকর্ষণীয়ভাবে চেতনাকে জাগ্রত করার উদ্যোগ। এতে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মানুষ ও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার যে বিবরণ রয়েছে তাতে একটি মহাসত্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেই মহাসত্যটি হলো, মানুষ ও প্রকৃতির স্রষ্টা ও শাসনকর্তা একই সত্তা, মানুষ আল্লাহর পরিচালিত এই মহাবিশ্বের একটি অংশবিশেষ। আল্লাহর আনুগত্য শুধু মানুষ করে না; বরং গোটা বিশ্ব-প্রকৃতিই আল্লাহর অনুগত। আর সর্বব্যাপী আনুগত্য থেকে কারো বিচ্যুত হওয়া বোকামি ও নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়। ‘তুমি বলো, হে আল্লাহ তায়ালা, হে বিশ্ব-সাম্রাজ্যের অধিপতি, তুমি যাকে চাও রাজত্ব দাও…’। ২৬ নম্বর আয়াতের এই বক্তব্যে আসলে আল্লাহর একক উলুহিয়াত ও সার্বভৌমত্বই প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি একমাত্র ইলাহ বিধায় একমাত্র অধিপতিও। তিনি এককভাবে বিশ্ব-সাম্রাজ্যের মালিক ও অধিপতি। এতে তাঁর কোনো অংশীদার নেই। উপরন্তু তিনি নিজ কর্তৃত্বাধীন রাজ্য থেকে যেটুকু ইচ্ছা, যাকে ইচ্ছা দান করেন। অতঃপর যখন যার কাছ থেকে চান তা ফেরতও নেন। অর্থাৎ সম্পদে কারো মালিকানা মৌলিক নয় যে, সে নিজের খেয়ালখুশি মতো তা ব্যবহার করবে। সম্পদের আসল মালিক তাকে এ সম্পদ কিছু নির্দিষ্ট শর্তে ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দান করেন। ক্ষণস্থায়ী মালিক যখন এ সম্পদে আসল মালিকের শর্তের পরিপন্থী আচরণ করে, তখন সেই আচরণ বাতিল ও অবৈধ হয়ে থাকে। পার্থিব জীবনে মুমিনদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এ ধরনের সম্পদ আসল মালিককে ফেরত দেয়া।
অনুরূপভাবে তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন আর তাঁর সে ফয়সালায় কেউ বাধা দিতে পারে না। কেননা, কেউ তার বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে পারে না এবং কেউ তা রদও করতে পারে না। কারণ তিনিই সর্বেসর্বা, তিনিই নিরঙ্কুশ ও একচ্ছত্র কর্তৃত্বের মালিক। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এই সর্বাত্মক ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী আর কেউ নেই। তিনি যাকে চান সম্মানিত করেন এবং যাকে চান অসম্মানিত করেন। এসব তিনি ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার সাথেই করেন। তিনি যা-ই করেন, সর্বাবস্থায়ই হয় তা সত্যিকার অর্থে কল্যাণজনক। ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তুমি রাতকে দিনের এবং দিনকে রাতের ভেতরে প্রবেশ করাও …’ প্রকৃতির যে বিরাট সত্যটি এখানে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা মানুষ মাত্রেরই হৃদয়, চেতনা, দৃষ্টি ও অনুভূতিকে আকৃষ্ট করে। প্রকৃতির শক্তিসমূহের একটির অপরটির ভেতরে গোপনে ও সন্তর্পণে ঢুকে পড়ার যে দৃশ্যটি রাত ও দিনের পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ এবং জীবিত ও মৃতের পরস্পর থেকে বের করে আনার মধ্য দিয়ে দৃষ্টিগোচর হয়, তা আসলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, প্রকৃতির শক্তি ও বস্তুসমূহের এই গতিশীলতায় আল্লাহর হাত রয়েছে। মানুষ একটু লক্ষ করলেই এই হাতের সক্রিয়তা অনুভব করতে পারে। এই অন্ধকারময় ভূপৃষ্ঠকে আলোকময় সৌরজগতের সামনে এমনভাবে পালাক্রমে সঙ্কুচিত করেন যে, রাতের অন্ধকার চুপিসারে দিনের আলোর দিকে চলে আসে, আবার একটু একটু করে আঁধারের মধ্য থেকে ভোরের আলো বেরিয়ে আসে। আর কোনো বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে এরূপ দাবি করাও সম্ভব নয় যে, এই গতি কারো পরিকল্পনা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া আপন থেকেই সংঘটিত হয়। জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারটিও তেমনি। ধীরে ধীরে একটির মধ্যে আর একটির অনুপ্রবেশ ঘটে। এই সূক্ষ্মদর্শী মহাপরিচালকের বিধানের বাইরে গিয়ে মানুষ কিভাবে নিজেদের জীবনকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে পারে? সেই মহাবিজ্ঞানী বিশ্ব-প্রতিপালকের পরিচালনাধীন এই প্রকৃতিরই একটি অংশ হয়ে কিভাবে মানুষ নিজের জন্য নিজের মনগড়া জীবনবিধান রচনা করতে পারে? কিভাবেই বা মানুষ একে অপরকে গোলাম অথবা প্রভু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে? অথচ সব মানুষেরই জীবিকা আল্লাহর হাতে এবং সবাই আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। ‘তুমি যাকে চাও বিনা হিসাবে জীবিকা দাও’। এভাবে এ দু’টি আয়াতে মানুষকে সেই মহাসত্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হয়েছে, যাতে বিধৃত হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র ইলাহ, তিনিই সৃষ্টিজগতের একচ্ছত্র ও চিরঞ্জীব শাসক ও পরিচালক, তিনিই নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনিই বিশ্ব-সাম্রাজ্যের অধিপতি, সম্মানদানকারী ও অবমাননাকারী, জীবন ও মৃত্যুদাতা, জীবিকাদাতা ও ব নাকারী এবং সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচার ও কল্যাণ সহকারে মানুষ ও প্রকৃতির নিয়ন্তা ও বিধাতা। (জিলালিল কুরআন)
আল্লাহ জাল্লøা শানুহু মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আরো বলেন- ‘হে নবী, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো, কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না; অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সবকিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ কুশলী।’ (সূরা আল-আহজাব-১)
বিরাট এক বিস্ময় ও আফসোসের বিষয় হলো- আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান-অনুদান, লাখো নিয়ামত লাভ করে অকৃতজ্ঞ মানুষ তাঁর একত্ব ভুলে গিয়ে একপর্যায়ে সৃষ্টির পূজায় লিপ্ত হয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন মাজিদে বলেন- ‘হে (মানুষ), তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমরা নিজেদের ওপর আল্লাহ তায়ালার (সে) অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যখন শত্রু সৈন্য তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, অতঃপর আমি তাদের ওপর এক প্রচ- বায়ু প্রেরণ করেছি এবং তাদের কাছে পাঠিয়েছি এমন সব সৈন্য, যাদের তোমরা কখনো দেখতে পাওনি; তোমরা তখন যা কিছু করছিলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তা দেখছিলেন।’ (সূরা আহজাব-৯)
‘(অপর দিকে) সেসব (সৌভাগ্যবান) মানুষ, যারা নিজেরা (চোখে) না দেখেও তাদের সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করেছে, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য রয়েছে (আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে) ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (সূরা আল-মুলক-১২)
এত নিপুণ-নির্মল করে বলার পরও কিছু হতভাগা-হতচ্ছাড়া আছে, দিবালোকের মতো স্পষ্ট কল্যাণকর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অশুভ অন্ধকার অমানিশার অতল গহ্বরে। কে ফেরাবে তাদের!
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- ‘(হে নবী,) তুমি (এদের) বলে দাও (হ্যাঁ), তিনিই তোমাদের পয়দা করেছেন, তিনি তোমাদের (শোনার ও দেখার জন্য) কান এবং চোখ দিয়েছেন, আরো দিয়েছেন (চিন্তা করার মতো) একটি অন্তর; কিন্তু তোমরা খুব কমই (এসব দানের) কৃতজ্ঞতা আদায় করো।’ (সূরা আল-মুলক-২৩)
মনে রাখতে হবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে তিনি নিয়ামত বাড়িয়ে দেন। তাই সর্বান্তকরণে মহামহিম আল্লাহর পথে অটল অবিচল থাকতে হবে আর সেই সাথে অবশ্যই মানুষকে দয়াময় আল্লাহ তায়ালার পথে ডাকতে হবে। সেই সাথে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে জীবন দানের আকাক্সক্ষা লালন করার মানসিকতা থাকতে হবে। কারণ এর মধ্যেই রয়েছে দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতে মুক্তির সুপ্রশস্ত সোপান। এ ব্যাপারে আনাস ইবনু মালিক রা: থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় একটি সকাল কিংবা একটি বিকাল অতিবাহিত করা দুনিয়া ও তাতে যা কিছু আছে, তার চেয়ে উত্তম।’ (বুখারি-২৭৯২)
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক