আওয়ামী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র বাংলাদেশকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিলেন রংপুরের শহীদ আবু সাঈদ। তার এই আত্মত্যাগের কথা কখনোই ভুলবে না এ দেশের শান্তিকামী জনগণ। দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা আওয়ামী দুঃশাসনে এ দেশের কোটি কোটি জনতা যখন চরমভাবে নিষ্পেষিত নির্যাতিত ঠিক তখনই আওয়ামী মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের ছাত্রজনতাকে দেখিয়ে দিয়েছেন মানুষ মরে গিয়েও কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে সেই পন্থা।
গত ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তার এই বিরত্বের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে সব মহলে। বিশেষ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্য থেকেও জোর দাবি উঠেছে যে, শহীদ আবু সাঈদের আত্মত্যাগের ঘটনা ও পেক্ষাপট এবং তার বীরত্বগাঁথার যেন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ দিকে নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকারে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুছ গত ৮ আগস্ট শপথ নেয়ার একদিন পর রংপুরে গিয়ে আবু সাঈদের কবর জিয়ারত শেষে এক আবেগঘন বক্তব্যে বলেছেন, এ দেশের আগামী প্রজন্ম আবু সাঈদের আত্মত্যাগ নিয়ে গর্ববোধ করবে। আবু সাঈদের এই ঘটনা শুধু পীরগঞ্জের বিষয় না, কিংবা এটা শুধু বাংলাদেশের বিষয়ও না, বরং এটা আজ গোটা বিশ্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে এক আবু সাঈদের কারণে আজ আমরা এক নতুন বাংলাদেশ পেলাম। আবু সাঈদ শুধু এক পরিবারের সন্তান না। বাংলাদেশে যত পরিবার আছে সব পরিবারেরই সন্তান এই আবু সাঈদ। আজকে যারা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে তারা বড় হবে। স্কুলে তারা পড়বে এই আবু সাঈদের কথা। আবু সাঈদের জীবন থেকে তারাও শিক্ষা নেবে। ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে তারাও নিজেদের প্রস্তুত করবে। আবু সাঈদ আজ ঘরে ঘরে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তথা এনসিটিবিও মনে করে আবু সাঈদের আত্মত্যাগের এই বিষয়টি এ দেশের জন্য গৌরবের ইতিহাস। কারিকুলাম রিফর্ম কমিশনে ছাত্র-জনতার যৌক্তিক এই দাবির বিষয়ে এনসিটিবিও একমত হয়ে সুপারিশ পেশ করবে বলে জানিছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তা।
দেশজুড়ে কোটা সংস্কার বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় সোস্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়ে আবু সাঈদের এই আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসের পাতায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন পটুয়াখালী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি।
ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) রাতেই রনি তার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘সম্মানিত আবু সাঈদ’। প্রিয় ভাই আমার। কী বলে ডাকিবো আপনায়। বীর, মহাবীর, শহীদ নাকি মহাকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান! আজকের এই দিনে নুরুলদিনের সেই রংপুরে পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যেভাবে আত্মহুতি দিলেন এমন দৃশ্য ইতিহাসে পড়েছি। যে শহিদী তামান্না নিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে পরাজিত করলেন এমন ঘটনা ধর্মীয় পুস্তকে পড়েছি। কিন্তু ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বাংলার মাটিতে যে ইতিহাস তৈরি করলেন তা এই জাতির কৃতজ্ঞ সন্তানরা কেয়ামত পর্যন্ত স্মরণ করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী হাসনাত আব্দুল্লাহ গতকাল শুক্রবার রাতে নয়া দিগন্তের সাথে এ বিষয়ে আলাপকালে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমাদের অনেক ছাত্র শহীদ হয়েছেন। সাধারণ নাগরিকগণ দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষও জীবন দিয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। এই মুহূর্তে আমাদের প্রায়োরিটি হচ্ছে দেশের ল’ অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন (আইনশৃঙ্খলা) স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা। এরপর আমরা আমাদের আন্দোলনে যেসব ভাই জীবন দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণে রাখার মতো কিছু উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানাবো। সে ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন বাংলাদেশ গড়তে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের এই ত্যাগের বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মকে জানাতে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকে তো অবশ্যই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত যেন করা হয় সেই দাবিও আমাদের পক্ষ থেকে থাকবে। আমাদের ছাত্র জনতার এই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিষয়ে আগামী প্রজন্মও জানতে পারে সেই উদ্যোগ নেয়া হবে।
রাতে নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় রংপুরের পীরগঞ্জের সন্তান (বেরোবির ছাত্র) শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা আত্মত্যাগ করেছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের কথাই যেন আগামী প্রজন্ম জানতে পারে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, এবারের সংগ্রামে শুধু আমার ভাইয়ের একার জীবনের বিনিময়ে এই বিজয় অর্জিত হয়নি। এখানে অনেকেরই অবদান রয়েছে। তাই শুধু আমার ভাই আবু সাঈদ একা নন, অন্যান্য যারা শহীদ হয়েছেন কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন তাদের কথাও যেন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেই দাবিও আমরা আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদককে বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শহীদ আবু সাঈদের বিরত্বের কথা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিলে অবশ্যই এটা করা যাবে। এনসিটিবির কারিকুলাম রিফর্ম কমিশনের সভায় দেশের আপামর ছাত্র-জনতার যৌক্তিক এই দাবির বিষয়ে উপস্থাপন করা হবে। তবে একথা নিশ্চিত যে, জনগণের তথা ছাত্র-জনতার যৌক্তিক দাবির বিষয়ে এনসিটিবিও একমত হয়ে সুপারিশ পেশ করবে।