সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১২ অপরাহ্ন

বন্যা পরিস্থিতি: পাঁচ নদীর পানি বাড়ছে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০২৪

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদী খোয়াই, ধলাই, মুহুরী, হালদা ও কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টা তা অব্যাহত থাকতে পারে। এমনটাই জানিয়েছেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান।
তিনি জানান, এতে করে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ফেনী ও চট্টগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির খুব বেশি অবনতি হবে না।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, অবিরাম বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে আগামী ২৪ ঘণ্টায় মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীর পানি এবং ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী ও হালদা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। এসময় এসব এলাকায় নি¤œাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। কুমিল্লা জেলার গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং সংলগ্ন নি¤œাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
কেন্দ্র থেকে আরো বলা হয়েছে যে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার প্রধান নদীসমূহের পানিও কিছু পয়েন্টে সময় বিশেষে বৃদ্ধি পেতে পারে।
উজানের ঢলে বিপৎসীমা অতিক্রম গোমতীর পানি: গত কয়েক দিনের টানা ভারীবর্ষণ ও প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে উজানের থেকে আসা ঢলের পানিতে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ভারতের ত্রিপুরা থেকে খরস্রোতা পানিতে গোমতীর চরের ফসলী জমি ও বাড়িঘর ভেসে গেছে। এতে হাজার হাজার মানুষ তীরে অবস্থান করছে। ষোলনল ইউনিয়নের কিংবাজেহুড়া গ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী এনামুল হক শান্ত বলেন, গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের পালপাড়া থেকে নানুয়ার বাজার পর্যন্ত এলাকা ঘুরে দেখেছে কয়েকটি স্থান। স্থানীয় লোকজন বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার কাজ করছে। পানি নদীর আইল (বেড়িবাঁধের) চার ফিট নিচে রয়েছে। বুড়িচং উপজেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম পিয়াস বলেন, ভারত থেকে পানি এসে গোমতীর চর প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার কয়েকটি স্থানে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বেড়িবাঁধ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমরা স্বেচ্ছাসেবি টিম তৈরি করতেছি। স্বেচ্ছাসেবি টিম নিয়ে গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ রক্ষা এবং সাধারণ মানুষের সহযোগীতা করার কাজে নেমে পড়ব।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহিদা আক্তার বলেন, আমি বুড়িচং উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছি। এতে গোমতীর বেড়িবাঁধের ছয় স্থানে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পানি উন্নয়ণ বোর্ডের লোকজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় লোকজন মিলেমিশে বস্তা দিয়ে মেরামত করছে।
তিনি আরো বলেন, বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়ে গেলে বিপদ কেটে যাবে। এখনো বড় ধরণের কোনো বিপদ হয় নাই। বুড়িচং উপজেলার কংশনগর এলাকায় দুটি, গোবিন্দুপুর এলাকায় দুটি, কাহেতরা এলাকায় একটি এবং ভান্তি এলাকায় একটিসহ বেড়িবাঁধের
ছয়টি স্থানের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বুড়িচং, ব্রাহ্মণাড়া এবং দেবিদ্বার উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর মেজর নাজিউর বলেন, এসব কাজগুলো সিভিল প্রশাসনের। সিভিল প্রশাসন থেকে আমাদের কাছে সহযোগীতা চাইলে আমরা তাদের কাজে সহযোগীতা করি।
উজানের পানিতে প্লাবিত ৮ জেলা: পানিতে ডুবে গেছে খাগড়াছড়ির নিচের বাজার এলাকা। সেই এলাকা দিয়ে চলাচল করছে লোকজন।
বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি জমি তলিয়ে আছে পানিতে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় এমনই অবস্থা ফেনীর তিন উপজেলা পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায়। প্লাবিত হয়েছে এই তিন উপজেলার শতাধিক গ্রাম, পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ।
নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিন দিন ধরে বেশির ভাগ ঘরবাড়ি জলমগ্ন হয়ে আছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের সব কটিই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
টানা বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি ছড়া ও নদ-নদী দিয়ে তীব্র বেগে ভারত থেকে আসছে পানি। এতে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট ও মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
ফেনীর আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সেলিম বলেন, এর আগে সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফেনীর বাসিন্দারা। গত ৩৬ বছরে অনেকবার বন্যা হলেও এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। এবারের বন্যায় পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার ৯০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকে কয়েকটি ডিঙি নৌকায় পানিবন্দী মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। উদ্ধারে নামেন ফায়ার সার্ভিসের লোকজনও।
উজান থেকে নেমে আসা পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরাচ্ছেন এক ব্যক্তি। গতকাল সকালে সকালে কুমিল্লা সদর উপজেলার চানপুর এলাকায়
সর্বশেষ গতকাল বুধবার বিকেল থেকে পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে নেমেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ছয়টি স্পিডবোটে করে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন সেনাসদস্যরা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও তিনটি স্পিডবোটে উদ্ধারকাজ শুরু করেছেন।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উদ্ধার তৎপরতায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডও যুক্ত হচ্ছে। বন্যার কারণে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কসহ স্থানীয় সব গ্রামীণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যায় উদ্ধারকাজে সহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী ছয়টি স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছেন। আরও ছয়টি স্পিডবোট ফেনীর পথে রয়েছে। বিজিবির সদস্যরাও কাজ করছেন। কোস্টগার্ডও উদ্ধার তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে।
গতকাল সকালে নোয়াখালী শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হরিনারায়ণপুর, কাজি কলোনি, লইয়ার্স কলোনি, রশিদ কলোনি ও কৃষ্ণরামপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বাসাবাড়ির আঙিনায় বৃষ্টির পানি থই থই করছে।
রশিদ কলোনি এলাকার বাসিন্দা মনু দাশ গুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ায় তাঁর বসতঘরের ভেতরেও পানি ঢুকে পড়েছে। সাপ ও পোকামাকড়ের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তাঁর। এ পরিস্থিতিতে রান্নাবান্না করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার বসন্তপুর গ্রাম
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার বসন্তপুর গ্রামছবি: সংগৃহীত
খাগড়াছড়ি সদর ও পানছড়ি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আরও অবনতি হয়েছে দীঘিনালা উপজেলায়। দীঘিনালায় এখনো হাজারো মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। দীঘিনালার সঙ্গে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা ও লংগদু উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের সব কটিই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন উপজেলার প্রায় এক লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ি ঢলে ভাঙন দেখা দিয়েছে ধুরং নদের বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থানে। ফটিকছড়ির ইউএনও মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, বন্যায় পাশের রাউজান উপজেলার প্রায় ৮টি ইউনিয়ন এবং হাটহাজারী উপজেলার ৮-১০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সকাল ছয়টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সীতাকু-ে বৃষ্টির পরিমাণ ১৯৩ মিলিমিটার।
কুমিল্লার গোমতী নদীতে পানি বেড়ে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত থেকে বৃষ্টি ও ঢলের পানি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। গোমতী নদীর আদর্শ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, গোমতীর তীর ঘেঁষে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। চরাঞ্চলের কয়েক হাজার একর সবজিখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
মালাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন আজাদ বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে চরের ভেতর বসবাস করেন। গত ১০ বছর গোমতী নদীতে এত পানি দেখেননি।
ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর ও আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্ট প্লাবিত হয়েছে। আজ সকাল ১০টার পর ইমিগ্রেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পানির তোড়ে গাজীর বাজার এলাকায় একটি অস্থায়ী সেতু ভেঙে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে মানুষের বাড়িঘর।
সিলেটে বুধবার বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমলেও কমেনি মানুষের ভোগান্তি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফলে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে লোকজন ভোগান্তিতে পড়েন। অনেকেই এমন বৃষ্টির কারণে ঘর থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হননি।
মৌলভীবাজারে মনু নদের পানি বিপৎসীমার ১১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য প্রধান তিন নদ-নদী ধলাই, জুড়ী ও কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর বাঁধ ভেঙে, উপচে ৬২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com