সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বিষয় মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, ক্ষমতা ও রাজত্বের সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু সৃষ্টিজগতের কিছু বিষয়কে আল্লাহ নিজের শিআর বা নিদর্শন আখ্যা দিয়েছেন, যাকে ইসলামের নিদর্শন ও প্রতীক বলা হয়। আল্লাহ ও তাঁর দ্বিনের নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা মুমিনের ঈমানের দাবি। নিচে আল্লাহর নিদর্শন ও ইসলামের প্রতীক নিয়ে আলোচনা করা হলো।
ইসলামের প্রতীকের পরিচয়: প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, প্রতিটি এমন জিনিস ইসলামের প্রতীক বলে গণ্য হবে যা মুমিন ও কাফির, মুসলিম ও অমুসলিম, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দেয়; যার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানকে চিহ্নিত করা যায়। ইমাম কুরতুবি (রহ.) ‘শাআইরুল্লাহ’-এর সংজ্ঞা দিয়ে বলেন, প্রত্যেক এমন জিনিস যা তাঁর পরিচয় বহন করে এবং তাঁর কথা মনে করিয়ে দেয়। আল্লাহর দ্বিনের নিদর্শনগুলোও শিআর। বিশেষত যেসব বিষয় হজের সম্পর্কে সম্পর্কিত। (তাফসিরে কুরতুবি : ১৪/৩৮৮)
কোরআনে বর্ণিত ইসলামের প্রতীক: পবিত্র কোরআনে কয়েকটি বিষয়কে আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো: ১. সাফা ও মারওয়া পাহাড় : ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৮)
২. কোরবানির পশু : আল্লাহ বলেন, ‘এবং (কোরবানির) উটকে করেছি আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩৬)
৩. পবিত্র মাসগুলো : অর্থাৎ রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম।
৪. হজযাত্রী বা হজ কাফেলা : ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! আল্লাহর নিদর্শনের, পবিত্র মাসের, কোরবানির জন্য কাবায় প্রেরিত পশুর, গলায় পরানো চিহ্নবিশিষ্ট পশুর এবং নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ ও সন্তোষলাভের আশায় পবিত্র ঘর অভিমুখে যাত্রীদের পবিত্রতার অবমাননা করবে না।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ২)
ইসলামের অন্যান্য প্রতীক: কোরআনে বর্ণিত প্রতীকগুলো ছাড়াও ইসলামের আরো অনেক প্রতীক বা নিদর্শন রয়েছে। এসব নিদর্শন হাদিসের বর্ণনা, উলামায়ে কেরামের চিন্তা-গবেষণার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। যার কয়েকটি হলো: ১. ব্যক্তি ও বস্তু : পবিত্র কোরআন, সব নবী ও রাসুল (আ.), সাহাবি ও হক্কানি উলামায়ে কেরাম।
২. স্থান : কাবা, আরাফাহ, হাজরে আসওয়াদ, মিনা, মুজদালিফা, জামারাত, সাফা-মারওয়া, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসাসহ পৃথিবীর সব মসজিদ।
৩. সময় : চারটি হারাম মাস, রমজান মাস, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, জুমা ও আইয়ামে তাশরিকসহ জিলহজের প্রথম ১০দিন।
৪. ইবাদত : কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, আজান, ইকামত, নামাজের জামাত, জুমার জামাত, ঈদের জামাত, জানাজা, চন্দ্রগ্রহণের নামাজ, সূর্যগ্রহণের নামাজ, খতনা করা, দাড়ি রাখা, কোরবানি করা।
৫. পোশাক-পরিচ্ছদ : টুপি, পাঞ্জাবি, মিসওয়াকসহ সব সুন্নতি পোশাক-পরিচ্ছদ ইসলামের প্রতীক। বিশেষত যে বিষয়গুলোর মাধ্যমে মুসলমানের পরিচয় চিহ্নিত করা হয়। (মুজমালু উসুলি আহলিস সুন্নাহ : ১০/১৬)
ইসলামের প্রতীক সম্পর্কে মুমিনের বিশ্বাস: আল্লাহর নিদর্শন ও ইসলামের প্রতীক বিষয়ে মুসলমানের বিশ্বাস হলো এগুলো বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। তবে আল্লাহর হুকুমের বাইরে এসব ব্যক্তি, বস্তু ও স্থানের বিশেষ কোনো ক্ষমতা নেই। এগুলোর বরকতও আল্লাহর ইচ্ছাধীন। নি¤েœাক্ত হাদিস থেকে আল্লাহর নিদর্শনের ব্যাপারে মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা স্পষ্ট হয়। হাদিসে এসেছে, ওমর (রা.) হাজরে আসওয়াদের নিকটবর্তী হয়ে তাতে চুমু দিয়ে বললেন, আমি জানি, তুমি একটি পাথর মাত্র। তোমার মধ্যে উপকার বা ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতা নেই। আমি যদি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তোমায় চুমু খেতে না দেখতাম তাহলে আমি কখনো তোমাকে চুমু দিতাম না। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৮৭৩)
ইসলামের প্রতীকগুলোর বিধান: ইসলাম যেসব বিষয়কে আল্লাহ ও দ্বিনের প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করেছে, তার প্রতি সম্মান করা অপরিহার্য। এটা ঈমান ও আল্লাহভীতির দাবি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করলে এটা তো তার হৃদয়ে বিদ্যমান আল্লাহভীতির অনুকূল।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩২)
ইসলামের প্রতীককে অসম্মান করার বিধান: আল্লাহর নিদর্শন ও ইসলামের প্রতীকগুলোর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহর হুঁশিয়ারি হলো, ‘হে মুমিনরা! আল্লাহর নিদর্শনের, পবিত্র মাসের, কোরবানির জন্য কাবায় প্রেরিত পশুর, গলায় পরানো চিহ্নবিশিষ্ট পশুর এবং নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ ও সন্তোষলাভের আশায় পবিত্র ঘর অভিমুখে যাত্রীদের পবিত্রতার অবমাননা করবে না।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ২)
অসম্মানকারীর অন্তরের অবস্থা বিবেচনায় তা কখনো কখনো কুফরি হিসেবেও গণ্য হতে পারে। কোনো মুসলমান তা জেনেবুঝে করলে তার ঈমান চলে যাবে। এ বিষয়ে উপমহাদেশের বিখ্যাত দ্বিনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া বিন্নুরিয়া আলামিয়া, পাকিস্তানের ফতোয়া হলো, ‘ইসলামের প্রতীকগুলো সেসব বিশেষ বিধানের নাম, যাকে সমাজে মুসলমান হওয়ার নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়। যেমন—কোরআন, রাসুলুল্লাহ (সা.), কাবাঘর, অন্যান্য মসজিদ, উম্মতের আলেমরা, আজান, খতনা, কোরবানি, মানাসিকে হজ ইত্যাদি। দাড়িও ইসলামের প্রতীক বা নিদর্শন। তার অসম্মান করা কুফরি।’ (সিরিয়াল ৫৪১২, ফতোয়া নম্বর ৪০০৪১) ইমাম শামী (রহ.) বলেন, ইসলামের কোনো প্রতীক নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও তাচ্ছিল্য করা কুফরি। (ফাতাওয়ায়ে শামি : ৫/৪৭৪)
আল্লাহ তাঁর নিদর্শন ও ইসলামের প্রতীকগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের তাওফিক দিন। আমিন।