দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ
১১ আগস্ট, বাংলাদেশ পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, গোটা বাহিনীকে দেশের জনগণ শত্রু ভাবতে শুরু করেছে। পদত্যাগপত্রে খুলনা-বরিশাল ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, “গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রীদের কাছ থেকে অবৈধ আদেশ পালন করতে বাধ্য হয়েছি। এই নিষ্ঠুর এবং বর্বরোচিত আদেশগুলো একটি বেআইনি শাসনকে রক্ষা করা এবং কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ক্ষমতা এবং আর্থিক লাভকে প্রসারিত করার জন্য কায়েম করা হয়েছিল।’ মনিরুজ্জামানের পদত্যাগপত্র এমন এক সময়ে এলো যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে। হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী এবং কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সিস্টেমের সংস্কার নিয়ে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন একটি ব্যাপক আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি জুড়ে অস্থিরতার ঢেউ তুলেছিল। যার জেরে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা এবং সেইসঙ্গে স্ব-নির্বাসনে চলে যান। বিক্ষোভের জেরে শুধু হাসিনার সরকারই নয়, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীও, যাকে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হতো, জনরোষের ভারে ভেঙে পড়ে। হাসিনার শাসনের অবসান উদযাপনের জন্য উল্লসিত জনতা রাস্তায় জমায়েত হওয়ার সাথে সাথে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাড়তে থাকে সহিংসতা। ঢাকা এবং শহরের বাইরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রায় সম্পূর্ণ পতন ঘটে।
এমনকি ৪ আগস্ট পর্যন্ত, হাসিনার দলীয় কর্মীদের পাশাপাশি পুলিশও বিক্ষোভের সময় আন্দোলনকারীদের উপর নির্মমভাবে হামলা চালিয়েছিল। জুলাইয়ের প্রথমদিকে শুরু হওয়া বিক্ষোভের ফলে ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ – প্রধানত ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিক-নিহত হয় এবং কয়েক হাজার আহত হয়। এই ক্র্যাকডাউনের পর দেশের মানুষ পুলিশকে ‘জল্লাদ’ ভাবতে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতা মাহমুদ উল হক বলছেন, “পুলিশ বাহিনী হাসিনার রাজনৈতিক দলবলে পরিপূর্ণ যারা তার ফ্যাসিবাদী শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সবকিছু করেছে। তারা এই গণহত্যার জল্লাদ যেখানে আমার শত শত ভাই-বোনকে নৃশংসভাবে হত্যা ও আহত করা হয়েছিল। বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষই এ ধরনের গণহত্যামূলক আদেশ পালন করতে পারে না।”
রংপুরের উত্তরাঞ্চলীয় জেলায় আবু সাঈদ নামে একজন নিরস্ত্র ছাত্রকে পুলিশের গুলি করে হত্যা করার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এটি সেই শত শত ভিডিওর মধ্যে একটি ছিল যা পুলিশ অফিসারদের দ্বারা সংঘটিত বর্বরোচিত আচরণকে প্রকাশ করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা যাচাই করা সাঈদের হত্যার ভিডিওটি ‘জুলাই গণহত্যার’ প্রতীক হয়ে উঠেছে। একটির পর একটি ভিডিওতে উঠে এসেছে আহত ছাত্রদের বেদনাদায়ক গল্প, সন্তানহারা পরিবারগুলোর আর্তনাদ। কারোর চোখে গুলি লেগেছে , কারোর শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে গেছে স্প্লিন্টার- পুলিশের প্রতি আজ ব্যাপক ঘৃণা জন্মেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
এতকিছুর পরেও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের সহিংসতা থামেনি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, তারা এক সপ্তাহ ধরে ব্লক রেইড চালিয়েছে, এমনকি যখন কোনো সক্রিয় বিক্ষোভ ছিল না, তখন ১১,০০০ জনকে আটক করা হয়– যাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশের বেশি ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিক ছিলেন।
প্রেসিডেন্টের আদেশে ৬ আগস্ট বন্দীদের সকলকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পুলিশের এই আচরণ সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। পুলিশ বাহিনী বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষা করার শপথ নেয়া সত্ত্বেও – বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্দেশে পেশীশক্তির আস্ফালন দেখিয়ে এসেছে, বিশেষ করে বিক্ষোভের সময়। যদিও এই গ্রীষ্মের প্রতিবাদ আন্দোলন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। কারণ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দমন করতে গোলাবারুদ, টিয়ার গ্যাস থেকে শুরু করে নৃশংস বল প্রয়োগ-কোনো কসুর বাকি রাখেনি পুলিশ বাহিনী।
এখন, হাসিনা চলে যাওয়ায়, জনগণের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানের উপর, যেটি একসময় তাদের দমিয়ে রেখেছিলো। এই ক্রোধের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বহিঃপ্রকাশ ঘটে হাসিনার পদত্যাগের পরপরই, যখন জনতা সারা দেশে পুলিশ স্টেশনে হামলা চালায়, জ্বালিয়ে দেয় এবং অফিসারদের সাথে সহিংস সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ৫ আগস্ট, হাসিনার ভারতে এয়ারলিফটের খবর প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘন্টা পরে রাজধানীর অন্যতম প্রধান আইন প্রয়োগকারী কেন্দ্র উত্তরা পূর্ব থানা সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। শত শত ক্ষুব্ধ নাগরিক পুলিশ স্টেশনে ঢুকে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পোশাকধারী অফিসাররা ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করার নিরর্থক প্রচেষ্টায় মরিয়া হয়ে কাঁদানে গ্যাস ও শূন্যে গুলি ছুড়তে শুরু করে।
হামলার সময় উপস্থিত তুষার আবদুল্লাহ সেই ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে বলছেন, আমি দেখেছি গুলিবিদ্ধ লোকজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মত ছিল। মানুষ চিৎকার করছিল, চারদিকে দৌড়াচ্ছিল। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে খুব অসহায় বোধ করছিলাম।’ এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। যাত্রাবাড়ি , তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর ও খিলগাঁও থানায় একই ধরনের হামলার খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সারা দেশে ৪৫০ টিরও বেশি থানায় হামলা করা হয়েছে । সহিংসতা এতটাই তীব্র ছিল যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ অফিসারদের তাদের পদ খালি করার নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে রিপোর্ট করা হয়েছে যে জনতার হামলায় কমপক্ষে ৪২ জন পুলিশ নিহত হয়। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ৬ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত বাংলাদেশের ২ লাখ ১০ হাজার পুলিশ কর্মকর্তার একজনও সারা দেশের কোনো থানায় উপস্থিত ছিলেন না।
গুলশান বিভাগের এসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ নুরা আলম তাদের স্টেশন পরিত্যাগ করার নির্দেশের মুহূর্তটি বর্ণনা করে বলছেন -“আমাদের অস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সুরক্ষিত করার এবং তারপর থানা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি খুব বিপজ্জনক ছিল। আমাদের পোস্ট ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।” সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনটি পুরো দেশ কার্যত পুলিশের উপস্থিতি ছাড়াই কাটিয়েছে। যে বাহিনীটি একসময় হাসিনার সরকারের স্তম্ভ ছিল, সেই বাহিনী জনসাধারণের সুরক্ষা দেবার পরিবর্তে বিক্ষোভের ভারে ভেঙে পড়েছিল।
দেশে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতি শূন্যতা তৈরি করে, নাগরিকদের আতঙ্কিত করে তোলে। কারওয়ান বাজারের ৬০বছর বয়সী বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম তার আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন, “বিরোধী দলের সদস্যরা প্রতিশোধ নেওয়ার কারণে শহরটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে। আমাদের রক্ষা করার কেউ ছিল না । এটা ভয়ঙ্কর।”
পরের দিনগুলোতে পরিস্থিতি কেবল আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ট্রাফিক সমস্যার জন্য ইতিমধ্যে কুখ্যাত ঢাকা। পুলিশের অনুপস্থিতির কারণে শহরের রাস্তাগুলিতে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। তবে সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনুপস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকরা নিজেরাই হাতে আইন তুলে নেন। আবদুল্লাহ নোমানের মতো ছাত্রনেতারা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দেশব্যাপী রাস্তায় নেমেছিলেন। নোমান, একজন তরুণ ছাত্র যিনি গত চার সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদে সামিল ছিলেন এবং বাংলাদেশকে এর মূল থেকে সংস্কার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, মন্তব্য করেছেন, “আমরা যে প্রতিবাদ করেছি তার জন্য এভাবে সবকিছু ভেঙে পড়ুক তা চাইনি। লোকেদের হাসপাতালে যেতে হবে, কাজে যেতে হবে এদিকে সাহায্য করার জন্য কেউ নেই। আমরা যদি এগিয়ে না যেতাম কে করতো ?’
ইতিমধ্যে, দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে, যা বাংলাদেশে বহু বছর ধরে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পুলিশ বাহিনী অনুপলব্ধ হওয়ায় রাজধানী জুড়ে বাসিন্দারা নিজেরাই রাস্তায় টহল দিয়ে নিজেদের রক্ষা করার পথ বেছে নেন। নতুন অন্তর্র্বতী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম দায়িত্ব নেয়া উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন কর্তৃক একটি আল্টিমেটাম জারি করার পর পুলিশ বাহিনী থানায় ফিরে না আসা পর্যন্ত আতঙ্কিত বাসিন্দারা, বিশেষ করে ছাত্ররা, রাতের প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ন হন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পুলিশকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলো । হোসেন ঘোষণা করেন যে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ৮ আগস্টের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তাকে ‘অনিচ্ছুক’ বলে গণ্য করা হবে। জনসাধারণের উদ্দেশেও তিনি সংযমের আহ্বান জানান বলেন, “পুলিশকে আক্রমণ করবেন না। অনুগ্রহ করে পুলিশের প্রয়োজনীয়তা বোঝার চেষ্টা করুন।”
সঙ্কট সমাধানের জন্য, নবনিযুক্ত অন্তর্র্বতী সরকার পুলিশকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সংস্কারের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়। সবচেয়ে দৃশ্যমান পরিবর্তনগুলোর মধ্যে একটি ছিল পুলিশ ইউনিফর্ম এবং লোগো পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত – একটি প্রতীকী আচরণ যা অতীত থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দেয়। গত ৬ আগস্ট নিযুক্ত পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোঃ মইনুল ইসলামের সাথে এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে পুলিশ কর্মকর্তাদের মানসিকতা গঠনে ইউনিফর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগোতে পরিবর্তনের বিষয়টি পর্যালোচনা ও প্রস্তাব করার জন্য ১৩ আগস্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়, যার রিপোর্ট পরবর্তী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই পদক্ষেপটি, প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অনেকের মনে সংশয়ের জন্ম দেয়, তারা এই ধরনের ভাসা ভাসা পরিবর্তনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। একজন প্রাক্তন আইজিপি এই ধারণাটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন যে ইউনিফর্ম পরিবর্তন করলে আরও ভাল পারফরম্যান্স হবে, বিশেষ করে পুলিশের মতো বেসামরিক বাহিনীতে।
ইউনিফর্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে অন্তর্র্বতী সরকার বিক্ষোভ দমনে সহিংসতার আশ্রয় নেয়া অফিসারদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু করে। গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে হয় অবসরে বাধ্য করা হয় বা পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। নিরস্ত্র ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত দুই কর্মকর্তাকে এ ঘটনায় তাদের ভূমিকার জন্য বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত আইজিপি মোঃ তৌফিক মাহবুব চৌধুরীকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের নতুন প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ শাখার প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামসহ অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলীকে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে পুনর্নিযুক্ত করা হয়েছে, যদিও তাদের ভূমিকা থাকবে নন একটিভ।
সব থেকে বেশি ধাক্কা দেয়া হয় ডিএমপিতে। বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য ১২ জন পুলিশ সুপারকে আনা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অভ্যন্তরে ৫০টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের রাজধানীর বাইরে বদলি করা হয়। মইনুল ইসলাম এসব কর্মকা-ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ‘আমরা বাহিনীকে শুদ্ধ করতে চাই, কিন্তু কারো অপরাধ ধামাচাপা দিতে চাই না।’
একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ক্রিমিনাল ল ব্যারিস্টার ড. মেহযেব চৌধুরী, যিনি বিশ্বব্যাপী ৫০টিরও বেশি পুলিশ বাহিনীর সাথে কাজ করেছেন তিনি বলছেন, সংস্কারের পথ চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীর সমস্যাগুলো অনেক গভীরে প্রোথিত। শুধুমাত্র কসমেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এর সমাধান করা যাবে না। বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্নীতির দীর্ঘ ইতিহাস এর নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। আস্থা পুনর্গঠনের জন্য পুলিশ যেভাবে কাজ করে এবং জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ করে তার একটি মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। ‘
ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডিপ্লোম্যাটের সামনে স্বীকার করেছেন যে ২০১২ সাল থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে ‘চরম অবিশ্বাস’ তৈরি হয়েছে, যখন পুলিশ ব্যাপকভাবে বল প্রয়োগ করতে শুরু করে। তিনি এও স্বীকার করেছেন যে, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আচরণগত সমস্যাগুলোর জন্যে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের উদ্রেক হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে, বর্তমান পরিস্থিতি পুলিশের জন্য খুবই জটিল। ‘হাসিনার পদত্যাগের পরপরই নয় দফা দাবিতে ধর্মঘটের সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের উত্থাপিত মূল দাবিগুলোর মধ্যে একটি ছিল রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বাহিনীকে মুক্ত করা। কর্মকর্তারা এমন সংস্কারের আহ্বান জানান যা তাদের রাজনৈতিক দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে স্বাধীনভাবে এবং পেশাগতভাবে কাজ করার সুযোগ দেবে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের মেয়াদে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি ফিল্ড লেভেলের পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছিল। ১০৫,৯২৫ কনস্টেবল এবং ১১,৫০০ সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ করা হয়েছিল ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে। অভিযোগ উঠেছে যে, এই নিয়োগের মধ্যে অনেকগুলো রাজনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে করা হয়। স্বজনপ্রীতি এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তদের নির্বাচিত করা হয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে হাইলাইট করা হয়েছে যে, নিয়োগের আগে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই করা হয়েছিল এবং এই রাজনৈতিকভাবে নিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী আন্দোলন দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ধর্মঘটকারী পুলিশের আরেকটি দাবি ছিল, বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের কাজের সময় অবশ্যই আট ঘণ্টা নির্ধারণ করতে হবে, অতিরিক্ত ঘণ্টার জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।বাহিনীর মধ্যে অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে তাদের ওপর কাজের অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হচ্ছে, যার ফলে তারা মানসিক চাপে রয়েছেন। আইজিপি বিষয়টি মেনে নিয়ে বলেন, “কাজের সময় আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে এবং কর্মকর্তাদের ওপর চাপ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।” ১৩ আগস্ট, পুলিশের সদর দপ্তর থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, সারাদেশে ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৬৩৪ টি আবার কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১১০টি মেট্রোপলিটন থানা এবং জেলার ৫২৯ টি থানার মধ্যে ৫২৪টি।
১৪ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে সারা দেশের থানার অফিসার-ইন-চার্জ এবং সাব-ইন্সপেক্টরদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন, পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সাব ইন্সপেক্টর মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘পুলিশের বর্তমান অবস্থা রাজনৈতিক শোষণ এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারী আদেশের পরিণতি। আমাদের এমন নেতৃত্ব দরকার যা জনগণের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে আমাদের নির্দেশ দেবে, রাজনৈতিক লাভের জন্য আমাদেরকেই জনগণের বিরুদ্ধে খাড়া করবে না। ছাত্র আন্দোলনকারীরা যে ধরনের পুলিশ অফিসারদের চাইছে তারা আমাদের বিভাগের মধ্যে বিদ্যমান হলেও তাদের নেতৃত্বে আনা হয় না। এই কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বাংলাদেশ পুলিশকে গাইড করার দায়িত্ব দেওয়া উচিত। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যারা তাদের ক্ষমতার বলে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকা-ের কারণে সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি আমাদের বিভাগের অফিসারদের মৃত্যুর সাথে জড়িত তাদের অবশ্যই বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। (মেহেদি হাসান মারোফ একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক যিনি রাজনীতি, পরিবেশ এবং সামাজিক পরিবর্তন সংক্রান্ত রিপোর্ট কভার করেন। সাকলাইন রিজভে একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফার যিনি দ্য ডিপ্লোম্যাটের জন্য ঢাকা থেকে রাজনীতি ও সমাজ কভার করেন। দৈনিক মানবজিমনের সৌজন্যে )