উজানের দেশ ভারত থেকে আসা ঢলে নজিরবিহীন বন্যায় দেশের ১১ জেলার ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলছে সরকারের তথ্য। মারা গেছেন ১৮ জন। প্রায় দুই মাস আগেও সিলেট, নেত্রকোনাসহ দেশের কয়েকটি জেলা বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় সেখানকার জনজীবন বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। দুই বছর আগে ২০২২ সালে সিলেট ও সুনামগঞ্জের মানুষ মুখোমুখি হয়েছিল শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায়। এখন আবার ভয়াবহ বন্যাকবলিত হলো দেশের কয়েকটি জেলা। সম্প্রতি ত্রিপুরার ডম্বুর গেট খুলে দিয়েছে ভারত। এতে ভারতের পানি ঢুকে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায়। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে এসব জায়গায়। সেখানকার বাসিন্দারা বলছেন, এই এলাকায় ১৯৮৮ সালের পর বন্যা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়নি আগে কখনো। ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে আসা পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা বন্যা আক্রান্তদের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। বন্যায় যে পরিমাণ মানুষ, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও জীবজন্তু আক্রান্ত হয়েছে, তাতে সহযোগিতা করার জন্য আরও অধিক সংখ্যক মানুষের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের প্রত্যেকেরই এগিয়ে আসা কাম্য। যার যার অবস্থান থেকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা এখন ইমানি দায়িত্ব। ইসলাম তাই বলে। কেননা মানবতা এখন বিপন্ন।
ইসলাম মানবতার ধর্ম। এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হলে তাদের পাশে দাঁড়ানো, বিপদ-মুক্তির জন্য সাহায্য করা ইসলামের শিক্ষা। তাদের দুর্দিনে আর্থিক সহায়তা, খাবার-দাবার, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসা ইমানের দাবি। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো অসহায় মানুষের সাহায্য করাও ইবাদত। আল্লাহতায়ালা মুমিনদের একটি দেহের মতো বানিয়েছেন। দেহের কোনো অংশ আক্রান্ত হওয়া মানে পুরো দেহ আক্রান্ত হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের উদাহরণ হলো, তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানবদেহের মতো। যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তখন তার পুরো দেহ ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা।’ (সহিহ মুসলিম)
যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের প্রতি অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে পবিত্র কোরআনে নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সেদিন আসার আগেই, যেদিন কোনো বেচাকেনা, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না।’ (সুরা বাকারা ২৫৪) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দয়াশীলদের ওপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ) এ ব্যয়, দান ও দয়া হতে হবে নিঃস্বার্থভাবে, অভাবী ও বিপন্ন মানুষের কাছ থেকে কোনো রকম প্রতিদানের আশা ছাড়া, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহতায়ালা এদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে। তারা বলে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবার দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা দাহর ৮-৯)
মানুষের বিপদে এগিয়ে এসে তার জন্য খরচ করাকে মহান আল্লাহ বিনিয়োগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর তা তিনি বহুগুণ ফেরত দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে? আল্লাহ তা তার জন্য বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন। আল্লাহই জীবিকা সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করেন। আর তোমরা তারই নিকট প্রত্যাবর্তন করবে।’ (সুরা বাকারা ২৪৫) এ আয়াতে আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার অর্থ হলো তার পথে খরচ করা। গরিব, অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা। পরকালে এর বিনিময় দেওয়া হবে সওয়াবরূপে।
রাসুল (সা.) সর্বদা অসহায় ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। মদিনার আনসার সাহাবিরা মুহাজির সাহাবিদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে তাবেইনরা আল্লাহর রাসুলের এ আদর্শ লালন-পালন করেছেন। পরবর্তী সুলতানি আমলের রাজা-বাদশাহরাও অসহায় মানুষের জন্য বিভিন্ন সরাইখানা, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। অতএব রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা ধারণ করে বন্যাকবলিত মানুষের পাশে যার যার সামর্থ্যানুযায়ী এগিয়ে আসা আমাদের ইমানি দায়িত্ব ও জাতীয় কর্তব্য।
সহিহ মুসলিমের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমাকে দেখতে আসনি। সে বলবে, হে প্রভু! কীভাবে আমি আপনাকে দেখতে যাব? আপনি তো সারা জাহানের পালনকর্তা। তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল। তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে তাহলে অবশ্যই তুমি আমাকে তার কাছে পেতে।’ এখন আমরা যদি বন্যার্ত মানুষের পাশে না দাঁড়াই তাহলে পরকালে মহান আল্লাহর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে যে, ‘আমি বিপন্ন ছিলাম, আমায় সাহায্য করোনি কেন?।’ তখন কী উত্তর দেবেন? তাই আসুন যার যার অবস্থান থেকে বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই। লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
atikr2047@gmail.com