শরিয়ত হলো এমন এক প্রেসক্রিপশন, যা দিয়ে মানবজীবনের সব সমস্যার সমাধান নিরসন করা যায়। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) আরব ও তার আশপাশের অন্যান্য বিধ্বস্ত সমাজের অবস্থা সংশোধন করেছেন আর এভাবেই মানুষের খারাপ অবস্থা ও দুর্দশা উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। (মুসাদ্দাসে হালি, পৃষ্ঠা-১৭) এই নববী রাষ্ট্র বিপ্লবের মৌলিক চিন্তাধারা ও মূলতন্ত্র কী, যা মানুষের মধ্যে চিরন্তন পরিবর্তন এনে দুঃখকে সুখে পরিণত করেছে? নি¤েœ তা তুলে ধরা হলো—
নববী রাষ্ট্র বিপ্লবের মৌলিক চিন্তাধারা: তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ), রিসালাত ও আখিরাত—ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও মূলতন্ত্র নববী রাষ্ট্র বিপ্লবের মৌলিক বিষয়। প্রতিটি ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক তাওহিদ তথা একত্ববাদের বিশ্বাস সম্পৃক্ত।
যেখানে পরকালে বিশ্বাসী ব্যক্তির সম্পর্ক মানুষের জীবন ও আচরণের প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং নবুয়তে বিশ্বাসী ব্যক্তির সম্পর্ক (ইসলামী) আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত। (হিকমতে বালেগা, পৃষ্ঠা-১২৬)
একত্ববাদে বিশ্বাসের তিনটি প্রধান প্রভাব আছে: ১. মানুষের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে খিলাফত ২. ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে আমানত ৩. সঠিক সামাজিক সাম্য ব্যবস্থা
একত্ববাদে বিশ্বাসের এই তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.), যিনি মানবতার পথপ্রদর্শনের শেষ রাসুল ও মূর্ত প্রতীক। তিনি এই বিষয়ে ১৩ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং ঈমানদারদের কাছে সেগুলো ভালোভাবে বুঝিয়েছেন, এর ফলে যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস (ঈমান) স্থাপন করেছিল এবং বিভিন্ন রকমের কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করেছে, তবু তারা এই পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি।
মানুষের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে খিলাফত: খাঁটি একত্ববাদের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোর মধ্যে প্রথম জিনিসটি হলো সার্বভৌমত্ব (ঝড়াবৎবরমহঃু), যা আল্লাহর সঙ্গে বিশেষায়িত, যেখানে মানুষের সার্বভৌমত্বের স্থান নেই। অর্থাৎ সৃষ্টিগত সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সঙ্গে আইন প্রণয়নকারী সার্বভৌমত্বও আল্লাহ তাআলার অধীনে। মানুষ তার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। আল্লাহ তাআলা যা ইচ্ছা তা-ই করবেন বা আদেশ দেবেন।
বিষয়টি পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কোরো না। এটাই সরল পথ, কিন্তু বেশির ভাগ লোক তা জানে না।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪০)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘শুনে রাখো, কর্তৃত্ব তো তাঁরই আর হিসাব গ্রহণে তিনিই সর্বাপেক্ষা তৎপর। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৬২)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘মহিমাময় সেই সত্তা, যার হাতে গোটা রাজত্ব। তিনি সব কিছুর ওপর পরিপূর্ণ শক্তিমান।’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ১)
ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে আমানত: একত্ববাদের চিন্তাধারার দ্বিতীয় বৈপ্লবিক ধারণা হলো, যেটিতে (স্থায়ীভাবে) মানুষের কোনো ব্যক্তিমালিকানা নেই। যেমন (আল্লাহর আইনে) কোনো শাসক নেই, তেমনি কোনো মালিকও নেই। আল্লাহই প্রকৃত শাসক এবং আল্লাহই প্রকৃত মালিক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যা কিছু আছে আকাশম-লে এবং যা কিছু আছে পৃথিবীতে, সব আল্লাহরই (চূড়ান্ত মালিকানায়)।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৮৪)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা আল্লাহরই এবং তাঁরই দিকে সব বিষয় ফিরে যাবে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৯)। এমন বহু আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে যেমন প্রকৃত শাসক একমাত্র আল্লাহ, একইভাবে মহাবিশ্বের সব কিছুর প্রকৃত মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। শেখ সাদী (রহ.) বলেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা কেবলই আমানতস্বরূপ, প্রকৃতপক্ষে এগুলোর প্রকৃত মালিক তো আল্লাহ তাআলা।’ (গুলিস্তাঁ, পৃষ্ঠা-৪৩) কবি ইকবাল বলেন, ‘মানুষ তো শুধু আমানতের রক্ষক। আল্লাহ তাআলাই প্রকৃত মালিক। মালিক ছাড়া যা কিছু দেখছো তা সবই ধ্বংসশীল।’ (কুল্লিয়াতে ইকবাল, পয়গামে আফগানি, পৃষ্ঠা-৮০/৬৬৮)। মোটকথা, ইসলামে সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে খিলাফত এবং মালিকানার পরিবর্তে আমানতের ব্যবস্থা রয়েছে।
সঠিক সামাজিক সাম্যব্যবস্থা: একত্ববাদের চিন্তাধারার তৃতীয় বৈপ্লবিক দিক হচ্ছে সঠিক সামাজিক সাম্য। যেমন মানব ইতিহাসে মানুষ সার্বভৌমত্ব ও মালিকানার শৃঙ্খলে উঁচু-নিচুর মধ্যে ভুগছে, একইভাবে তারা এই সন্দিহানে ভুগছে যে কেউ নিকৃষ্ট আবার কেউ উচ্চবিত্তের সঙ্গে সম্পর্কিত।
একত্ববাদের বিশ্বাস এই মানবিক চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে এবং একইভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদ, শূদ্রবাদ ও বর্ণবাদের সব বৈষম্য ধ্বংস করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী…।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১-২)। ড. ইসরার আহমেদ বলেন, ‘পরিপূর্ণ সামাজিক সাম্য না থাকলে সে সমাজ কোনো স্তরেই ইসলামী সমাজ বলে অভিহিত হওয়ার যোগ্য নয়।’ (হিকমতে বালেগা, পৃষ্ঠা-১৩৩)। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) এসব উঁচু-নিচুর বৈষম্য বিধ্বংস করার তাগিদে বলেন, ‘হে লোক সকল! শোনো, তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো, আরবির ওপর অনারবির এবং অনারবির ওপর আরবির, কৃষ্ণকায়ের ওপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের ওপর কৃষ্ণকায়ের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৪৮৯; শুআবুল ঈমান, বাইহাকি, হাদিস : ৫১৩৭)
মদিনা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নীতিমালা: ইসলামে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার এবং মানুষের অবস্থান হলো একজন খলিফা ও নায়েব হিসেবে। যেন তিনি মূল মালিকের মুখপাত্র, যিনি নির্ধারণকৃত নীতিমালা দিয়েছেন, যা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে এবং এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের শীর্ষে। তাই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, তাঁর রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক—তাদেরও। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তবে তোমরা আল্লাহ ও পরকালে সত্যিকারের বিশ্বাসী হয়ে থাকলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রাসুলের ওপর ন্যস্ত করো। এটাই উৎকৃষ্টতর এবং এর পরিণামও সর্বাপেক্ষা শুভ।’ (সুরা : আন নিসা, আয়াত : ৫৯)
সাংবিধানিক মূলনীতির সারাংশ: ১. আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য অন্য সব আনুগত্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ২. শাসকের (উলুল আমর) আনুগত্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য। ৩. বিচারক ঈমানদার হওয়া।
৪. প্রজাদের শাসক এবং সরকারের সঙ্গে বিতর্ক করার অধিকার। ৫. এই বিতর্ক নিষ্পত্তিমূলক কর্তৃত্ব আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর। ৬. উক্ত ব্যবস্থায় এমন একটি এজলাস থাকতে হবে, যা শাসক ও জনগণের চাপের ঊর্ধ্বে থাকবে এবং আইন অনুযায়ী বিরোধের নিষ্পত্তি করবে। (আল খিলাফাহ ওয়াল মুলক, পৃষ্ঠা-৪২)
এই সাংবিধানিক নীতিগুলোর মধ্যে তিন ধরনের আনুগত্য হলো এমন, যার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, যা নি¤েœ তুলে ধরা হলো : ১. আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ২. রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য ৩. উলুল আমর (শাসক)-এর আনুগত্য।
উল্লিখিত তিনটি আনুগত্যের মধ্যে তৃতীয় আনুগত্যও যা মুসলমানদের ওপর ফরজ, তাহলো উলুল আমরের (রাষ্ট্রীয় নেতা) যিনি মুসলমানদের মধ্যে থেকে হবেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করেন, তাহলে তিনিই হবেন মুসলমানদের মাননীয় ব্যক্তি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি তোমাদের ওপর এমন কোনো হাবশি (ইথিওপীয়) দাসকেও শাসক নিযুক্ত করা হয়, যার মাথাটি কিশমিশের মতো, তবু তার কথা শোনো ও তার আনুগত্য করো।’ (বুখারি, হাদিস : ৭১৪২)
ইমাম ইবনে হাজম (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ন্যায়পরায়ণ শাসকের আনুগত্য মুসলিম উম্মাহর ওপর ফরজ, যারা আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করে এবং আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আনীত শরিয়ত অনুযায়ী তাদের রাজনীতি পরিচালনা করে। (আল ফাসাল ফি আল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, খ–৪, পৃষ্ঠা-৭২)। এর সঙ্গে ইমাম ইবনে হাজম (রহ.) আরো দুটি শর্ত যোগ করে বলেন, ‘শাসক’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো :
১. মুসলমানদের শাসক ও সরকার: ২. তাকে অবশ্যই বিদ্বান ও আইনশাস্ত্রে পারদর্শী হতে হবে, যাকে ইমাম ইবনে জারির আত তাবারি (রহ.) ‘আহলুল হাল ওয়াল আকদ’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ ধীমান, চিন্তক, চতুর, দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়া। (জামিউল বয়ান, খ–৮, পৃষ্ঠা-৫০২)