টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা ঢলে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ১১ জেলার ৬টিতে এখনো দুর্যোগ কাটেনি। কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে পানি কমলেও উঠান ও রাস্তায় এখনো হাঁটুপানি। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অনেক এলাকার মানুষ হাঁটুপানি ভেদ করে বাড়ি ফিরে দেখছেন ঘরের জিনিসপত্র সবই নষ্ট হয়ে গেছে। ত্রাণের শুকনো খাবারই তাদের একমাত্র ভরসা। কুমিল্লায় আমন ধানের ক্ষেত এখনো ৮ ফুট পানির নিচে। বন্যায় গতকাল পর্যন্ত ৩১ জন মারা যাওয়ার খবর নিশ্চিত করা গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গতকাল পর্যন্ত বন্যায় ৫৮ লাখ ২২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। নোয়াখালীতে গতকাল এক দিনে সাপেকাটা ৪৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে দেশের ১১টি জেলায় বন্যায় মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেড়েছে। গত বুধবার বেলা একটা পর্যন্ত ৩১ জন মারা যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। বন্যায় মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৭।
গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত ১১টি জেলার ৭৩টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জেলাগুলো হলো ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১২, চট্টগ্রামে ৫, নোয়াখালীতে ৬, কক্সবাজারে ৩, ফেনীতে ২, খাগড়াছড়িতে ১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ ও লক্ষ্মীপুরে ১ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া মৌলভীবাজারে দু’জন নিখোঁজ আছেন।
সর্বশেষ প্রাপ্ত হালনাগাদ (বুধবার বেলা একটা পর্যন্ত) তথ্য অনুযায়ী, এখনো ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছে, যা আগের দিন ছিল ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪, যা গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ছিল ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৪ হাজার ৩টি। এগুলোতে ৫ লাখ ৪০ হাজার ৫১০ জনকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩৯ হাজার ৫৩১টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
শতাধিক পরিবার পানিবন্দী: নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের জোড্ডা পূর্ব ইউনিয়নের ধুড়িয়ারা ও ভবানীপুর গ্রামে শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত ১ সপ্তাহ ধরে অনেক পরিবারের চুলায় জ্বলেনি আগুন। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ওই এলাকায় সরকারি-বেসরকারি কোন ত্রাণ সহায়তা মিলেনি। স্থানীয় প্রবাসী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দেয়া শুকনো খাবারই তাদের একমাত্র ভরসা। এখনো প্রতিটি সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি।
১ দিনে সাপে কাটা ৪৪ জন হাসপাতালে: নোয়াখালী অফিস জানায়, নোয়াখালীতে ভারি বর্ষণ কমে গেছে বন্যার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও পানিতে তলিয়ে যাওয়া মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। বিশাল এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকায় নেটওয়ার্ক সমস্যায় দেখা দিয়েছে ও যোগাযোগ বিছিন্ন রয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎবিহিন সাপের ভয়ে রাতযাপন করছে বন্যায়কবলিত মানুষগুলো। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়ায় ভর্তি হয়েছে ৩০ জন। এ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৩০ জন।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) সৈয়দ মহিউদ্দিন আব্দুল আজিম বলেন বন্যার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে বুধবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩০ জন। এ ছাড়া ভর্তি আছে ১৩০ জন। তিনি বলেন, গত ১ সপ্তাহে নোয়াখালীতে ৯১ জনকে সাপে কেটেছে। গতকাল বুধবার সাপে কেটেছে ৪৪ জনকে।
মিরসরাইয়ে পানি কমলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চলছে যুদ্ধ: মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, মিরসরাইয়ে টানা সাত দিনের বন্যায় অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী ছিল। পানি কমে গেলেও এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে যুদ্ধ করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য কাঁচা ও মাটির ঘর। গত দুই দিন ধরে অধিকাংশ ঘর থেকে পানি নামলেও উঠানে ও গ্রামীণ সড়কে পানি থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারছে না মানুষ। গত বুধবার সকালে উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এখানে বানের পানি নেমে গেলেও অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। অনেক ঘরবাড়ি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
চলছে সর্বত্র ত্রাণ কার্যক্রম : বন্যা শুরুর পর থেকেই শতাধিক সংস্থা-সংগঠন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা একযোগে উদ্ধার ও ত্রাণকার্যক্রম শুরু করেন। এ সময় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোলা ৮২টি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ৩০ হাজার মানুষকে খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সহায়তা দেন এসব সরকারি-বেসরকারি বাহিনী, সংস্থা ও সংগঠন। এখানকার অতিদুর্গত এলাকায় সেনাবাহিনী, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও চট্টগ্রাম যুব রেড ক্রিসেন্ট অ্যালমনাই এর উদ্ধার কর্মীরা একদিকে যেমন উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তেমনি এসব এলাকায় ত্রাণকার্যক্রমও সফলভাবে সম্পন্ন করেন।
রাঙ্গামাটি শহরে পানিবন্দী হাজারো মানুষ: রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, সীমান্ত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের পানি বেড়েই চলেছে। হ্রদের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকায় এবার রাঙ্গামাটি শহর এলাকার হ্রদ তীরবর্তী বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন রাঙ্গামাটি শহর এলাকার হ্রদের পাড়ে বসবাসরত হাজারো মানুষ।
রাঙ্গামাটির ছয় উপজেলার মধ্যে বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলায় বন্যার পানি নামতে শুরু করছে। অন্য চার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। এখনো পানিবন্দী হয়ে আছে নানিয়ারচর, বরকল, কাউখালী ও বিলাইছড়ি উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ।
দেবিদ্বারে পানিতে তলিয়ে আছে কৃষকের স্বপ্ন: দেবিদ্বার (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আমার বাঁচার স্বপ্ন। কিভাবে কৃষি ব্যাংকের লোন পরিশোধ করব? ছেলেমেয়েদের নিয়ে ডালভাত খাওয়া এখন কষ্টকর হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আমার এক বিঘা পাকা আমন ধানের জমি। এক মুঠো ধানও কাটতে পারিনি, জমিতে প্রায় ৮ ফুট পানি। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে কৃষিকাজ করে কোনো রকমে সংসার চলাতাম। গতকাল বুধবার দুপুরে সরেজমিন এলাকা পরিদর্শনে গেলে দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ ইউনিয়নের ঘোসঘর গ্রামের কৃষক মজিবুর রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন কথা বলেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে কুমিল্লার বুড়িচং বুরবুড়িয়া এলাকায় গোমতি বাঁধ ভাঙার কারণে পার্শ্ববর্তী দেবিদ্বার উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। টানা বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাকা আউশ ধান কাটতে পারেনি কৃষকরা। বন্যার পানিতে শত শত হেক্টর আমন ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে, কিছু কিছু এলাকায় বসতভিটায় উঠেছে বন্যার পানি। উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে যাচ্ছে। ধানক্ষেতে থইথই করছে পানি। ভাঙনের পানির তোড়ে ভেসে গেছে বাড়িঘর ক্ষেত খামার, মাছের প্রজেক্ট। মাছ শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এক সপ্তাহ আগে যাদের সব ছিল- এখন তাদের অনেকেই নিঃস্ব।
ফেনীতে বন্যায় নিহত বেড়ে ১৭: ফেনী অফিস জানায়, ফেনীতে ভয়াবহ বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৭ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে ৫ জনের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। গতকাল বুধবার জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
জেলা প্রশাসক জানান, গত কয়েক দিনের টানা বন্যায় জেলায় ব্যাপক ক্ষতি এমনকি প্রাণহানি হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের চালতাতলী এলাকা থেকে অজ্ঞাত দুজন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ছাগলনাইয়া উপজেলায় একজন অজ্ঞাত নারী, সোনাগাজীর সুলাখালী এলাকার অজ্ঞাত পুরুষ, চরখন্দকার জালিয়াপাড়ায় অজ্ঞাত হিন্দু নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের ধনিকু-া এলাকার সাহাব উদ্দিনের লাশ ফুলগাজী উপজেলায় পাওয়া যায়। উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের দেলোয়ার হোসেন, ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপুর এলাকার শাকিল, উত্তর করইয়া এলাকার কিরন, দক্ষিণ শ্রীপুর এলাকার রাজু, কিসমত ঘনিয়ামোড়া এলাকার আবুল খায়ের, লক্ষ্মীপুর এলাকার সৈয়দ তারেক, শনিরহাট এলাকার রজবের নেছা, সোনাগাজী উপজেলার সমপুর এলাকার নাঈম উদ্দিন, ছাড়াইতকান্দি এলাকার আবির, দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর করিমপুর এলাকার নুর মোহাম্মদ মিরাজ, মমারিজপুর এলাকার আবদুর রহীম মারা গেছেন। তাদের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে এবং অজ্ঞাত ব্যক্তিদের লাশ শহরের বিভিন্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়।