বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৪২ পূর্বাহ্ন

দুই কারণে আমা‌কে গুম করা হয়েছিল: আযমী

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দুই কার‌ণে দীর্ঘ আট বছর গুম করে রাখা হ‌য়ে‌ছিল ব‌লে জা‌নি‌য়ে‌ছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মরহুম গোলাম আযমের মেজো ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
গতকাল মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম জুমে যুক্ত হয়ে একথা বলেন।
গুম হওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আযমী বলেন, আমাকে দুইটা কারণে আটকে রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো, আমার পৈতৃক পরিচয় এবং আমি ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। আমি সব প্রতিবেশী বন্ধু চাই। যে বন্ধু আমার ক্ষতি করে, তাকে শত্রু ছাড়া আমি বন্ধু ভাবতে পারি না। ভারত যতদিন বন্ধুসুলভ আচরণ করবে ততদিন আমি বুকে জড়িয়ে ধরব, ভারত যদি শত্রুর মত আচরণ করে, তাহলে আমি তাকে শত্রুই ভাবব এবং শত্রু বলে যাব। গুপ্ত বন্দিশালাতে থাকাকালীন আমাকে একজন বলেছে, আপনি বিদেশি শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। এই কারণে আমাকে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে, আপনি ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার কেন।
দীর্ঘ আট বছর গুপ্ত বন্দিশালা আয়নাঘরে থাকাবস্থায় দাঁত, চোখসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। সেই সুবাধে রাজনীতির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই হাসপাতাল থেকেই যুক্ত হন সংবাদ সম্মেলনে। যুক্ত হয়েই তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ, আহত ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যারা আহত-নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতি শোক, কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। সেইসাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদে প্রকৃত সংখ্যা ও জাতীয় সঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন। দাবি তোলেন, জাতীয় সঙ্গীত ও সংবিধান পরিবর্তনের।
তিনি বলেন, আমি এই জাতীয় সঙ্গীত এই সরকারের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমাদের এখন যে জাতীয় সঙ্গীত রয়েছে, সেটি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থী। এটা দুই বাংলা এক করার জন্য বঙ্গভঙ্গ রদের সময়কে উপস্থাপন করে। যে সঙ্গীত দুই বাংলা এক করার জন্য করা হয়, সেটা কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হতে পারে? এই সঙ্গীত ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীত করার জন্য অনেক গান রয়েছে। এই সরকারের উচিত একটা নতুন কমিশন গঠন করে একটি নতুন জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করা।
গেল আট বছর বন্দী থাকা অবস্থায় পৃথিবীর কোনও আলো দেখেন‌নি জা‌নি‌য়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেছেন, প্রতি রাতেই ক্রসফায়ারের ভয় থাকত। তারা খুব দুর্ব্যবহার করত আমার সঙ্গে।
আযমী বলেন, বারবার মনে হতো, তারা হয়তো আমাকে ক্রসফায়ার করে হত্যা করবে। আমি তাহাজ্জদ পড়ে আল্লাহর কাছে শুধু কান্না করতাম। আমার লাশটা যেন আমার পরিবারের কাছে যায়।
তি‌নি বলেন, যখন আমার বাসায় তারা এল, তখন তাদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, আপনারা কারা, পরিচয় কী, পরিচয়পত্র দেখান। আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও ওয়ারেন্ট আছে কি না, তা জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমার কথার জবাব দেয়নি।
তিনি বলেন, একপর্যায়ে আমাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠায়। আমার চোখ–মুখ বাঁধা অবস্থায় একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ফেলে রাখা হয়, অন্ধকার এক ঘরে। টয়লেট যেতে চাইলে চোখ–হাত বেঁধে নিয়ে যেত।
২০১৬ সালের ২২ আগস্ট রাতে আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে তুলে নেওয়া হয়। সে সময় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজধানীর বড় মগবাজারের বাসা থেকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাকে আটক করা হয়। পরে আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তবে, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে থেকে আটকের বিষয়টি একাধিকবার দাবি করা হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়। ৫ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনীর সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কচুক্ষেতে সমবেত হয়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) ‘আয়নাঘরের বন্দীদের’ মুক্তির দাবি জানান। এরপরই তারা মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন।

বিনা অপরাধে ৮ বছর পর ‘বন্দিশালা’ থেকে যেভাবে মুক্তি পেলেন আযমী
বিনা অপরাধে দীর্ঘ ৮ বছর ‘বন্দিশালা’ নামের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন তিনি মুক্তি পান। ৬ আগস্ট দিবাগত রাতে তাকে রাজধানীর বাইরে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় ছেড়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ৮ বছরের গুম জীবনের নানান বিষয়ে কথা বলতে গতকাল মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের অডিটোরিয়ামে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। সেখানে বন্দিদশা থেকে মুক্তির ঘটনা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন তিনি। আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, গত আগস্ট মাসের ৫ তারিখ যে বিপ্লব হয়েছে সেটি আমি জানতাম না। সেদিন (৫ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার সময় এসে আমাকে বলা হলো আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বললাম, আমিতো ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাই। যদি দুইটার দিকে আসে আমার সুবিধা হয়। তাদের আমি বললাম, কয়েকদিন আগেই আমাকে ডাক্তার দেখে গিয়েছেন। রক্ত পরীক্ষাও করলেন। এখন আবার আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন?
তখন তারা বললো, আপনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সে অনুযায়ী আমাকে মুখোশ পরিয়ে আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট রাতে যখন আমাকে বলা হলো, আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব। তখন আমি বললাম, আট বছর ধরে আপনাদের বলছি আমার দাঁত ভেঙে গেছে, আমার কানের সমস্যা হচ্ছে। এতদিন আপনাদের বলছি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, আপনারা নিয়ে যাননি। আর এখন বলছেন, হাসপাতালে যেতে হবে। এটা কেমন কথা?
এরপর চোখ বেঁধে আমাকে গাড়িতে তোলা হয়েছে। তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছিল। আমি বললাম ঢাকা শহরের কোনো হাসপাতাল তো এত দূরে না। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কেউ কোনো জবাব দিলো না। রাস্তা ভাঙাচোরা। আমি বললাম, ঢাকা শহরের কোনো রাস্তা তো এত ভাঙাচোরা না। আমি বললাম, আপনারা কি আমাকে কোনো গ্রামের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন নাকি? তারা কোনো জবাব দিলো না। পরে আমাকে আরেকটি বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, আমি অনুমান করতে পারি, ওইদিন রাস্তায় ছাত্র-জনতা গাড়ি চেক করছিল। সেজন্য তারা আমাকে গ্রামের রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছে। পরে তারা বলল, আপনি এখানে থাকেন। আমি বললাম, আপনারা না আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসবেন এটা কোথায় নিয়ে এলেন? তারা বললো, আপনাকে পরে জানানো হবে।
মুক্তির ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ৬ আগস্ট আমাকে একজন জানালো, আজ আমাকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। একজন বলল, আপনার কাপড়ের সাইজ বলেন। আমি বললাম, আমি তো গার্মেন্টের কাপড় পরি না, সাইজ বলতে পারবো না। পরে একটা কাপড় নিয়ে আসা হলো। যেটা আপনারা দেখেছেন মুক্তির পরে প্যান্ট-শার্ট। ওটা পরে দেখলাম ঠিক আছে। বাইরে কী হচ্ছে সে খবরই তো নাই আমার কাছে। পরে সোয়া ৯টার দিকে আমাকে নিয়ে তারা রওনা হলো। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা সড়কের পাশে আমাকে নিয়ে তারা ছেড়ে দিলো। বললো, গাড়ি আসবে গাড়িতে উঠে আপনি চলে যাবেন। তখন রাত পৌনে বারোটা বাজে।
গাড়ি ভাড়া হিসেবে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা আমাকে টাকা দিলো। আমি বললাম ঢাকার ভাড়া কত? তারা বললো, ঠিক জানি না। বললাম, এখানে কত টাকা আছে। তারা বলল, পাঁচ হাজার টাকা। আমি বললাম আমি আপনাদের টাকার মুখাপেক্ষি নই। এখান থেকে ঢাকার ভাড়া যত সেই টাকাই দিন। তারা বলল আপনি যা করেন, করেন দান করেন, কিছু টাকা আপনাকে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে এক সেকেন্ড কথা বলার আমার রুচি ছিল না। এরপর তারা আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
মুক্তির সেই মুহূর্তের সম্পর্কে আযমী বলেন, যখন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয় আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। এরপর দেখলাম একটা গাড়ি আসছে। আমার মনে হচ্ছিল, ঝাঁপ দিয়ে বাসে মধ্যে উঠি। পরে আমি বাসে উঠলাম। আমার স্ত্রী এবং চাচাতো ভাইয়ের ফোন নম্বর আমার মনে ছিল। বাসের একযাত্রীর থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে আমি তাদের ফোন করি। বাস আমাকে টেকনিক্যাল মোড়ে নামিয়ে দিলো। এরপর পরিবারের সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে ৮ তারিখ ভোরে আমি বাসায় গিয়ে পৌঁছি।
আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, দীর্ঘ বন্দিশালা কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে আমি ৮ বছর পর মুক্তি পেয়েছি। অন্যায়ভাবে আমাকে এখানে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হয়েছিলো। বন্দি জীবনে মৌন প্রতিবাদ হিসেবে নিজের চুল বড় রেখেছি।
আযমী বলেন, আমার দিনগুলো কেমন কেটেছে মনে হলে বুক ফেটে যায়। একদিন আমাকে এসে বলা হলো, ‘আপনার লিখিত দিতে হবে। সেখানে আপনি লিখবেন, আমি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবেন না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বিদেশে সুখে শান্তিতে থাকতে চাই৷ আমি বিদেশে চলে যাব।’
তখন আমি বলেছি, আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আপনারা আমাকে অবৈধভাবে অপহরণ করেছেন। আটক করে রেখেছেন, আমাকে নির্যাতন করছেন। আমি এটা প্রতিবাদে মিছিল মিটিং করতে পারছি না। তাই মৌন প্রতিবাদ হিসেবে বড় চুল রেখেছি। আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা আমি রাজনীতি করবো কি করবো না, আমি এ দেশে থাকবো কি থাকবো না। আল্লাহ আমাকে সেই সৎ সাহসটুকু দিয়েছিলেন। আমি এটা দৃঢ় ভাবেই বলেছি। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে গুমের শিকার হন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আজমের সন্তান আবদুল্লাহিল আমান আযমী। দীর্ঘ ৮ বছর পরে গত ৬ আগস্ট দিবাগত রাতে তিনি কথিত সেই ‘আয়না ঘর’ থেকে মুক্তি পেয়েছেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com