৫৭২ খ্রিস্টাব্দ : শিশু মুহাম্মদকে এই সময় আরবের ধাত্রী প্রথা অনুযায়ী দুধ পানের জন্য বনু সাদ বংশের ধাত্রী হালিমার গৃহে পাঠানো হয়। অবশ্য মুহাম্মদ (সা.) জন্মের পর প্রথমে আপন মাতা আমিনা এবং কিছুদিন পর চাচা আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবার দুধ পান করেছিলেন। এরপর পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশু মুহাম্মদ (সা.) ধাত্রী হালিমার কাছেই ছিলেন। যদিও এর মাঝে দুই বছর পর মুহাম্মদ (সা.) মায়ের কোলে আবার কিছুদিনের জন্য ফিরে এসেছিলেন।কিন্তু মক্কার আবহাওয়া তখন খারাপ হয়ে পড়েছিল। অন্যপক্ষে সন্তানের অনুপম দেহকান্তি দর্শনে আমিনা ও আত্মীয়গণ তাঁকে আরো কিছুদিন হালিমার গৃহে রাখা বাঞ্ছনীয় মনে করেন। এর আরেক কারণ ছিল এই যে বানু সা’দ গোত্রের ‘আরবি ছিল বিশুদ্ধ এবং লালিত্যপূর্ণ’। পরবর্তীকালে দুগ্ধমাতা হালিমা রাসুল (সা.)-এর কাছে খুবই সম্মান পেতেন। মহানবী (সা.) নিজ গায়ের চাদর বিছিয়ে হালিমার জন্য আসন করে দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর সংস্পর্শে হালিমার শারীরিক এবং পারিবারিক শ্রীবৃদ্ধি লাভ হয়েছিল।
হালিমার গৃহে থাকাকালীন মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় হয়েছিল। হালিমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনি ছাগ-মেষ চরাতে যেতেন। কিন্তু বালসুলভ ক্রীড়া-কৌতুকে বা কলহে যোগদান করতেন না। তখন থেকেই তাঁর মধ্যে আত্মসমাহিত ভাব এবং ভাবুক প্রকৃতির উন্মেষ হয়েছিল।
বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনায় দেখা যায়, হালিমার গৃহে থাকাকালীন একবার ফেরেশতারা তাঁর বক্ষবিদারণ করে তাঁর হৃদপি-কে ইমানের জ্যোতিতে পূর্ণ করে দেন। এতে ভয় পেয়ে ও বিপদ হতে পারে ভেবে স্বামীর পরামর্শে হালিমা বালক মুহাম্মদকে মাতা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসেন।
৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ : পিতা-মাতা দুই-ই হারিয়ে নবী (সা.)-এর এতিম হওয়ার বছর।
পিতাকে আগেই হারিয়েছিলেন তিনি। মাতা আমিনা তাঁর স্বামী আবদুল্লাহর কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে ছয় বছরের মুহাম্মদকে নিয়ে মদিনার পথে রওনা দেন। ফেরার পথে হঠাৎ মাতা আমিনাও ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে মা আমিনার বয়স হয়েছিল মাত্র ২০ বছর।
৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ : পিতা-মাতাকে হারিয়ে শিশু মুহাম্মদ (সা.) লালিতপালিত হচ্ছিলেন দাদা আবদুল মুত্তালিবের স্নেহে। এ বছর দাদাকেও হারান। দাদার বয়স তখন ছিল ১২০ বছর।
৫৮৩ খ্রিস্টাব্দ : নতুন অভিভাবক পেলেন মুহাম্মদ। বয়স তখন ১২ বছর দুই মাস ১০ দিন। দাদার মৃত্যুতে চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে আসেন। ব্যবসা উপলক্ষে চাচার সঙ্গে সিরিয়ায় রওনা হন।
ইহুদি প-িতের ভবিষ্যদ্বাণী : সিরিয়ার পথে তায়মা নামক স্থানে নবীজি (সা.) বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। জনৈক ইহুদি প-িত বুহায়রা রাহিব নবীজি (সা.)-কে দেখে থমকে গেলেন। চাচা আবু তালিবকে জিজ্ঞেস করলেন, বালকটি কে?
আবু তালিব ভাতিজার পরিচয় দিলেন। ইহুদি প-িত বললেন, ‘সিরিয়া গেলে ইহুদিরা তাঁকে মেরে ফেলবে। এ বালক বড় হয়ে আল্লাহর নবী হবে। তাওরাতকে সে রহিত করে দেবে এবং ইহুদি ধর্মযাজকদের রাজত্বের অবসান ঘটাবে।’
ধর্মীয় কিতাব তাওরাতে মহানবী (সা.)-এর পূর্ণ অবয়ব ও আকৃতির বিস্তারিত বিবরণ ইহুদিদের জানা ছিল। এ সময় একজন নবী আসবেন, তা-ও তারা জানত। আশঙ্কিত আবু তালেব সিরিয়া সফর বাতিল করে মক্কায় ফিরে আসেন। ইহুদি প-িত বুহায়রা রাহিবই প্রথম নবী হিসেবে মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন সংবাদ ব্যক্ত করেন। ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন, সিরিয়াগামী কাফেলার ওপর বুহায়রা এক খ- মেঘ উড়তে দেখেছিলেন। পরে তিনি দেখতে পান, মেঘখ- বালক মুহাম্মদকে ছায়া দিচ্ছে। পরে আসমানি কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী বুহায়রা বালক মুহাম্মদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিরীক্ষা করেন এবং দুই কাঁধের মাঝখানে নবুয়তের মোহর অঙ্কিত দেখতে পান। (ইবনে হিশাম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৩) রাখাল পেশা : ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। বালক মুহাম্মদ (সা.)-কে এই সময় পশু চরাণো এবং গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকতে হতো। তিনি স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের পশু চরাতেন। কাজের ফাঁকে তিনি দুর্বল এবং দুস্থদের দুঃখ দূর করার চেষ্টা ও ফিকির করতেন। এটাও আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার একটি প্রথা ও রীতি যে তিনি প্রায় সব নবী (আ.)-কেই সবর ও বিনয় শেখানোর জন্য প্রথম জীবনে রাখালের কাজ করিয়েছেন। মুহাম্মদ (সা.)-ও প্রথম জীবনে এই রাখাল পেশায় থেকে ধৈর্য ও স্থৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
কালো পাথর সরানোর ঘটনা : এই সময়ে দেশে-বিদেশে নানা কর্মে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যে চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে তিনি জনগণ কর্তৃক ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত আখ্যায় ভূষিত হন।
ঘটনাক্রমে কাবাগৃহের পুনর্র্নিমাণের সময় যখন কালো পাথর পুনঃস্থাপনকে কেন্দ্র করে গোত্রীয় লড়াই লাগার উপক্রম হয়েছিল, তখন প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী তারা রক্তপূর্ণ পাত্রে হাত রেখে শপথ করেছিল যে শাণিত তরবারিই এই প্রশ্নের মীমাংসা করবে। তখন বৃদ্ধ আবু উমায়রের প্রস্তাবে সবাই সম্মত হলো যে এরপর কাবায় সর্বপ্রথম আগন্তুকের ওপর এই জটিল প্রশ্নের মীমাংসার দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। এই সিদ্ধান্তের পর ঘটনাক্রমে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বপ্রথম কাবায় আগমন করলেন আর অপেক্ষমাণ জনতা সমস্বরে ধ্বনি তুলল, এই যে আমাদের আমিন আসছে, আমরা তার বিচার মেনে নেব।
সব কথা শুনে হজরত মুহাম্মদ (সা.) কালো পাথরটি নিজ হাতে তুলে একটি চাদরের ওপর স্থাপন করলেন এবং প্রত্যেক গোত্রের একজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে চাদরের প্রান্ত ধরে পাথরটি বহন করতে বললেন। সবাই হজরত (সা.)-এর নির্দেশ মেনে তা নির্দিষ্ট জায়গায় আনলেন। এবার নবী (সা.) আবার নিজ হাতে পাথরটি তুলে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। মুহাম্মদ (সা.)-এর নিরপেক্ষতা এবং উপস্থিত বুদ্ধি দেখে সবাই তারিফ (প্রশংসা) করলেন।