বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে নিহত শহীদ শিক্ষার্থী আব্দুল কাইয়ুমের (২৫) পরিবারে চলছে শোকের মাতম। মাস পেড়িয়ে গেলেও দুর্বিষহ যন্ত্রণায় দিন যাপন করছেন বাবা-মা আর ভাই-বোন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পরিবারটি। ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন তারা। আব্দুল কাইয়ুম ছিলেন ২৫ বছরের তরতাজা যুবক। পড়াশোনা করতেন কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ে। ২০২৩ সালে একাউন্টিংয়ে অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
বাবা আর বড় ভাইয়ের আয়ের উৎস না থাকায় বেশ কয়েক বছর ধরেই সংসারের হাল ধরেছিলেন কাইয়ুম। টিউশনির পাাশাপাশি করতেন ক্ষুদ্র ব্যবসাও। পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে করতেন দিনরাত হাড় ভাঙ্গা খাটুনি। অত্যন্ত ধার্মিক আব্দুল কাইয়ুম পরিবারের সদস্যদের মতোই এলাকাবাসীর কাছেও ছিল বন্ধু-বৎসল আর সদালাপী। ৫ আগস্ট সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে ঘাতকের একটি বুলেট কেড়ে নেয় আব্দুল কাইয়ুমের জীবন। এলোমেলো করে দেয় সবকিছু। সেই সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যায় পরিবারের সব স্বপ্নও।
সাভার পৌরসভার ডগড়মোড়া এলাকার বাসিন্দা কফিল উদ্দিন। স্ত্রী আর দুই ছেলে কাউছার আহমেদ এবং আব্দুল কাইয়ুমকে নিয়ে তাদের সংসার। একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে আগেই। বাবা আর বড় ভাইয়ের আয়ের কোন উৎস না থাকায় নিজেই সংসারের হাল ধরেন আব্দুল কাইয়ুম। টিঁউশনি করতেন। প্যারাগন নামের ছিল নিজস্ব কোচিং সেন্টারও। ভালোই চলছিল তাদের সংসার। ছিল না কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। নির্ঝঞ্ঝাট আব্দুল কাইয়ুমের সঙ্গে এলাকাবাসীর ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। অনার্স শেষে ইন্টার্নি করে সাভারের বাড়িতেই ছিলেন আব্দুল কাইয়ুম।
৫ আগস্ট দুপুরে যোহরের নামাজের সময় বাড়ির বাইরে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে বের হতে গেলে মা, ভাবিসহ পরিবারের অন্যদের বাধার মুখে পড়ে সে। বাড়ির বাইরের সড়কে চলমান আন্দোলন আর গোলাগুলির আতঙ্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাড়ীর বাইরে যেতে বারবার নিষেধ করা হয় তাকে। ততক্ষণে শার্ট-প্যান্ট পড়ে নামাজ পড়তে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আব্দুল কাইয়ুম। মা’র কপালে চুমু দিয়ে মা’কে নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে যায় সে। এর কিছুক্ষণ পর ডগড়মোড়া এলাকার অদূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার নিউ মার্কেটের সামনে পৌঁছামাত্রই পেটের বামপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাইয়ুম। স্থানীয়রা ধরাধরি করে দ্রুত সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে আশংকাজনক অবস্থায় তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু জ্ঞান না থাকায় আর শেষ কথা হয়নি পরিবারের কারও সঙ্গে। পরদিন ৬ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে আব্দুল কাইয়ুমকে মৃত ঘোষণা করে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
আব্দুল কাইয়ুমের প্রতিবেশী আরিফুর রহমান বলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই ডগরমোড়া এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতো আব্দুল কাইয়ুম। আব্দুল কাইয়ুম জামাতের সহিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতো। তাবলীগ জামাতের আমীর ছিল সে। পাশাপাশি টিউশনি করতো। এলাকার প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ছিল তার সুসম্পর্ক। কেউ বলতে পারবে না কারও সঙ্গে কোনদিন খারাপ ব্যবহার করেছে। এ যুগে সচরাচর এমন ছেলে দেখা যায় না।
ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় আব্দুল কাইয়ুমের মা কুলসুম বেগম জানান, কাইয়ুমের মতো এতো দায়িত্ববান ছেলে এ যুগে পাওয়াই দুরূহ। বাবা-মা’সহ পরিবারের সকলের খেয়াল রাখতো সে। কার কী লাগবে, কী করতে হবে- সব কিছুই তার জানা থাকত।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সেদিন (৫ আগস্ট) বাড়ির বাইরে বের হতে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও নামাজ শেষে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে যাওয়ার জন্য বায়না করছিল। পরে অবশ্য শুধু নামাজ শেষ করেই বাড়ি ফেরার কথা ছিল কাইয়ুমের। আমার কপালে চুমু দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় সে। কিন্তু নিউমার্কেটের সামনে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে আর বাড়ি ফিরে আসা হয়নি তার। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। একদিন পর সেখান থেকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। এ আঘাত আমি সইবো কি করে? কথা বলতে বলতে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তিনি।
কুলসুম বেগম বলেন, যেইসব ঘাতকদের বুলেটের আঘাত আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা কিছুটা শান্তি পাবো। কিছুটা হলেও আমাদের কষ্টের বোঝাটা হাল্কা হবে।
আব্দুল কাইয়ুমের বড় ভাই কাউসার আহমেদ বলেন, বাবা বেকার। আমিও বেশকিছুদিন ধরে কাজ পাচ্ছি না। সংসারের এমন অবস্থায় আমার আদরের ছোট ভাই কাইয়ুমই হাল ধরেছিল পরিবারের। পরিবারের সবার খেয়াল রাখতো ভাইটি। আজ একমাস হয়ে গেলো কাইয়ুম আমাদের মধ্যে নেই। ক্ষণে ক্ষণে আমরা কাইয়ুমের অভাব অনুভব করছি।
কাইয়ুমের অভাব পূরণ হবার নয় উল্লেখ করে কাউসার আহমেদ আরও বলেন, এ ঘটনায় ইতোমধ্যে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমরা চাই প্রকৃত দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।
আব্দুল কাইয়ুমের ভাবী লাইজু আক্তার বলেন, কাইযুমের মতো দেবর পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তার মতো পরহেজগার যুবক এখনকার সময়ে খুব কমই দেখা যায়। বাবা-মা’র পাশাপাশি পরিবারের সবার খেয়াল রাখতো কাইয়ুম। কখনো কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি।
পুত্র শোকে কাতর আব্দুল কাইয়ুমের বাবা কফিল উদ্দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো বাবার কাঁধে ছেলের লাশ। আমি সেই হতভাগ্য পিতা যে নিজের ছেলের লাশ কবরস্থ করেছি। সেইদিন একটি বুলেট আমার পুরো পৃথিবী উলট-পালট করে দিয়েছে। তছনছ করে দিয়েছে আমার পুরো পরিবারকে। আমাদের বাবা-ছেলের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সুমধুর। আমরা সবকিছুই নিজেদের মধ্যে শেয়ার করতাম। অত্যন্ত পরহেজগার আব্দুল কাইয়ুম ছিল অত্যন্ত ভালো মনের। পরিবারের সকলের প্রিয়পাত্র ছিল সে। সবার সঙ্গেই তার ছিল ভালো সম্পর্ক। সবসময় ভালো ভালো চিন্তা করতো। কারও কিছু হলে উপকারের জন্য ছুটে যেত। আপ্রাণ চেষ্টা করতো উপকার করার। আজ ছেলেটি নেই একমাস হলো। আমাদের সকলের সুখ কেড়ে নিয়েছে আব্দুল কাইয়ুমের মৃত্যু। দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত আব্দুল কাইয়ুমরা ক্রান্তিলগ্নে বারবার ফিরে আসবে দেশবাসীর অগ্রদূত হয়ে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের। আব্দুল কাইয়ুমদের মৃত্যু নেই। তারা মৃত্যুঞ্জয়ী।