শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১২ অপরাহ্ন

রাষ্ট্রনায়ক মহানবী (সা)

প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমদ
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মানব মুকুটের লেখক মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী তার বইয়ের প্রস্তাবনায় লিখেছেন : ‘যে সব মহাপুরুষের আবির্ভাবে এই পাপ-পঙ্কিল পৃথিবী ধন্য হইয়াছে। যাহাদিগের প্রেমের অমুত সেচনে, দুঃখ তপ্ত মানবচিত্ত স্নিগ্ধ হইয়াছে। যাহারা মানবসমাজের যুগ-যুগান্তরের কুক্ষিগত কালিমা রশ্মির মধ্য হইতে সূর্যের ন্যায় উত্থিত হইয়া পাপের কুহক ভাঙিয়াছেন, ধর্মের নবীন কিরণ জ্বালাইয়াছেন ও পতিত মানবকে সত্য ও প্রেমে সঞ্জীবিত করিয়া নবীন জীবন পথে টানিয়া লইয়া গিয়াছেন, ইসলাম ধর্মের প্রচারক হজরত মুহাম্মদ (সা) তাহাদের অন্যতম।’ আমি জনাব চৌধুরীর সাথে একমত হয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে শুধু এটুকু সংযোজন করতে চাই : ‘হজরত মুহাম্মদ (সা) তা ছাড়াও ছিলেন বিশ্বমানবের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। তিনি ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়কও।’ এই ছোট্ট নিবন্ধে শুধু এই সম্বন্ধে দু’চারটি কথা বলতে চাই। সাধের জন্মভূমি পরিত্যাগ করে মক্কা থেকে যখন হজরত মুহাম্মদ (সা) ইয়াসরিবে পা রাখলেন, ইয়াসরিবের জনসমষ্টি তাঁকে অভূতপূর্ব পরিবেশে অত্যন্ত আবেগঘন আবহে স্বাগত জানালেন। ইয়াসরিব নগরীর চাবি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে শুধু প্রিয়তম ব্যক্তিত্বরূপে আপন করে নিলেন তাই নয়; এই নগরীর পরিচালনার সব দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁর নেতৃত্ব অবনত মস্তকে স্বীকার করে নিলেন। এই স্বীকৃতির প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ইয়াসরিবের জনগণ তাদের প্রিয় নগরীর নামকরণ করলেন ‘মদিনাতুন্নবী’ অথবা ‘মদিনাতুর রাসূল’। দিনটি ১২ রবিউল আউয়াল। খ্রিষ্টীয় ৬২২ অব্দের ২২ অথবা ২৪ সেপ্টেম্বর। একটি লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে (মদিনা চার্টার) বিশ্বের এই অংশে প্রতিষ্ঠিত হলো জনগণের সম্মতিভিত্তিক, কল্যাণমুখী, গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সৃষ্টি হলো অনবদ্য এক দৃষ্টান্ত। সর্বপ্রকার স্বৈরাচারমুক্ত। ব্যক্তি প্রভাবের ঊর্ধ্বে। প্রভুত্ববাদকে অস্বীকার করে সম্পূর্ণরূপে জনগণের সম্মতিভিত্তিক, চুক্তির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মদিনা রাষ্ট্রের জন্ম হলো। সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের খ্যাতনামা দার্শনিক জন লক যে তত্ত্বের ভিত্তিতে বলেছিলেন, ‘সেই রাষ্ট্রই সর্বশ্রেষ্ঠ যা শাসিতদের সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে’ (ঞযধঃ মড়াবৎহসবহঃ রং ঃযব নবংঃ ড়হ যিরপয রং নধংবফ ড়হ ঃযব পড়হংবহঃ ড়ভ ঃযব মড়াবৎহবফ) সেই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটে মদিনায় ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে এবং এই অনবদ্য সৃষ্টির মূলে ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মনীষী হজরত মুহাম্মদ (সা)। এই নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় মহানবীর নেতৃত্বে মসজিদে নববী। এই মসজিদই ছিল গণতান্ত্রিক মদিনা রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্বের প্রাণকেন্দ্র। আইন প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দু এবং ন্যায়নীতির শীর্ষস্থান, বিচার বিভাগের শীর্ষস্থান। মদিনা রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল মদিনা সনদ-৫৩ অনুচ্ছেদ সংবলিত লিখিত সংবিধান। এর ভূমিকায় সনদকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘কিতাব’ রূপে এবং আধুনিক অর্থে তা সংবিধান। সনদের ২৩, ৪০, ৪৬ ও ৫১ অনুচ্ছেদে সনদকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সহিফা’ হিসেবে এবং আধুনিক অর্থে তাও হলো সংবিধান। প্রকৃত প্রস্তাবে মদিনা সনদ ছিল একটি সংবিধান এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে এটাই হলো সর্বপ্রথম লিখিত পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। পাশ্চাত্যের প্রচারণায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজ্ঞতায় এবং মুসলিম প-িতদের ঔদাসীন্যের ফলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ছাত্রছাত্রীরা জানে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানই সমগ্র বিশ্বের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ১৭৮৯ সালে এর প্রায় সাড়ে এগার শ’ বছর আগেই রচিত হয়েছে মদিনা সনদ। রাসূলুল্লাহ হজরত মুহাম্মদ (সা) রাজনীতিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক রাষ্ট্রনায়ক, শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞায় বিভূষিত একজন জননেতা। যদি তিনি চাইতেন তিনি হতে পারতেন পরম পরাক্রমশালী সম্রাট। হতে পারতেন প্রবল প্রতাপান্বিত বাদশাহ। মহামহিম সুলতান। আর তখনকার বিশ্বে এইটিই ছিল নিয়ম। সূচনা করতে পারতেন রোমান সম্রাটদের অথবা পারস্য সম্রাটের মতো অথবা চীনের রাজাধিরাজের মতো, মিসরের ফেরাউনদের মতো সূচনা করতে পারতেন এক পারিবারিক ধারা (ফুহধংঃরপ ষরহব)। রাজনীতিক হলে তিনি হয়তো তাই করতেন, কেননা তখনকার বিশ্বে অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্রের চিহ্নমাত্র ছিল না। রাজনীতিকরা সবসময় বর্তমান কালেই বসবাস করেন। তাদের দৃষ্টি থাকে ক্ষমতার দিকে এবং ক্ষমতা প্রসূত সুযোগ-সুবিধা অথবা বৈভব-প্রভাবের দিকে। দৃষ্টি থাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অথবা পারিবারিক পর্যায়ে বিলাসিতার দিকে। আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক (ঝঃধঃবংসধহ) বর্তমানে বসবাস করেও তিনি দৃষ্টি রেখেছিলেন মানবজাতির ভবিষ্যতের দিকে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। মানবজাতির ঐক্য-সংহতির দিকেই তিনি দৃষ্টি রেখেছিলেন। দৃষ্টি দিয়েছিলেন তাদের পরিপূর্ণ জীবনের দিকে, তাদের ইহকালীন এবং পারলৌকিক সম্পূর্ণতার দিকে। জনসম্মতির ওপর ভিত্তি করে যে সব রাষ্ট্র পরে গড়ে ওঠে; যেমন ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের পরে ইংল্যান্ডের অবস্থা অথবা ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি উপনিবেশের অবস্থা অথবা ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্সের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সঙ্কটজনক। গৃহযুদ্ধের আগুনে ঝলসে গেছে সমাজ জীবন। অনিশ্চয়তার অন্ধকার থেকে গেছে চারদিক। কিন্তু মদিনা রাষ্ট্র বিশ্বময় মাথা তুলে স্থিতিশীলতার আশীর্বাদ নিয়ে সমৃদ্ধি ও শান্তিপূর্ণ অবস্থার সম্পদকে মূলধন করে বিশ্বজয়ী হয়ে ওঠে সেই মদিনা রাষ্ট্র। অথচ সপ্তম শতাব্দীতে রাষ্ট্র গঠনের আগে মদিনার অবস্থা ছিল অনেকটা নৈরাজ্যপূর্ণ। ওই সময়ে মদিনায় ছিল সুসংগঠিত আদি পৌত্তলিক সম্প্রদায়। ছিল দেশী ও বিদেশী ইহুদি জনগোষ্ঠী। তারপরে আসেন মক্কা থেকে হিজরত করে নব্য মুসলিমরা। প্রত্যেক ইতিহাসবিদ এ কথা অত্যন্ত জোরে প্রচার করেছেন যে, তখনকার আরব সমাজ ছিল গোত্র-গোষ্ঠীতে খ- ছিন্ন, শতধাবিভক্ত এবং ওইসব গোত্র-গোষ্ঠী-উপজাতি সব সময় লিপ্ত ছিল পারস্পরিক দ্বন্দ্বে। হিংসা-বিদ্বেষে, অসুয়াতাড়িত প্রতিহিংসার জিঘাংসায়। সমাজে ছিল না কোনো ঐক্যবোধ, ছিল না সহানুভূতি অথবা সহযোগিতার কোনো সূত্র। সংক্ষেপে, প্রাক-ইসলাম আরবে সমাজ জীবনে ‘নিঃসঙ্গ, দীন, কদর্য, পশুতুল্য এবং স্বল্পায়ু’ (ঝড়ষরঃধৎু, চড়ড়ৎ, হধংঃু, নৎঁঃরংয ধহফ ংযড়ৎঃ) মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর সৃজনশীল নেতৃত্বে এবং সীমাহীন আন্তরিকতার সেই খ- ছিন্ন শতধাবিভক্ত সমাজ জীবনের অফুরন্ত কল্যাণকামী প্রবাহের সৃষ্টি হয়ে তা পরে সাত শ’ বছরব্যাপী স্থায়ী হয়ে সমগ্র বিশ্বের চিন্তা-ভাবনাকে আলোকিত করে রাখে। সৃষ্টি করে নতুন নতুন সৃষ্টির প্রাণ যা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। মদিনা রাষ্ট্র শুধু মুসলমানদের রাষ্ট্র নয়; নয় কোরাইশদের অথবা মুহাজির বা আনসারদের। এই রাষ্ট্র সবার ধর্ম এবং সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার। মুসলমান ও ইহুদির। আদি পৌত্তলিক ও অমুসলিমদের। যে যার ধর্ম অনুসরণ করবে, কিন্তু জাতি হিসেবে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; এর প্রতিরক্ষায় সকলেই কৃতসঙ্কল্প। জাতীয়তার প্রকৃতি বিশ্লেষণকারী হাজারো তাত্ত্বিক আজ পর্যন্ত যে সব জটিল ক্ষেত্রে কোনো সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হননি, বিভ্রান্তির চোরাবালিতে পথ হারিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে মদিনা সনদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্বে কিভাবে সহজ এবং সরল পথে পথপরিক্রমা শুরু করেছিল তা আজো সবাই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পর্যালোচনা করে থাকেন। আধুনিক জাতীয়তার যেমন রয়েছে আকর্ষণীয় এক সম্মিলনের স্বর্ণসূত্র, অন্য দিকে তেমনি রয়েছে বিভাজনের এক প্রবণতা। কিছু সংখ্যক জনসমষ্টি একত্রিত হয়ে যেমন জাতি গঠন করে, তেমনি জাতি হিসেবে তারা বিশ্ব মানব সম্প্রদায় থেকে স্বাতন্ত্র্য অনুভব করে বিচ্ছিন্ন হয়েও পড়ে। মদিনা রাষ্ট্রটি কিন্তু এক উম্মাহর দেয়াল ডিঙিয়ে ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে রীতিনীতি এবং সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সব বাধা বন্ধনকে জয় করে, বিশ্বময় উম্মাহর পথ প্রশস্ত করেছে। যে চুক্তির ভিত্তিতে মদিনা রাষ্ট্রের জন্ম হয় সেই চুক্তিতে নবী করিম (সা) স্বাক্ষর করেন একজন জননেতারূপে সততার মূর্তরূপ জনকল্যাণকামী এক পরিপূর্ণ মানুষরূপে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকত, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব গণতন্ত্রের উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হয়ে যেত সপ্তম এবং অষ্টম শতকেই। পাশ্চাত্যে আজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গণইচ্ছা, গণঅধিকার, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে গর্ব করে এবং গর্বভরে বলে থাকে যে একই ভিত্তিতে উন্নত এক সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে রাসূল করিম (সা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গণসম্মতিভিত্তিক মদিনা রাষ্ট্রের আদর্শ সার্বিকভাবে বাস্তবায়িত হলে মানবজাতি উন্নত পর্যায়ে উন্নীত হতে পারত। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের বিশেষজ্ঞ এবং পর্যালোচকদের চোখে মদিনা রাষ্ট্রের গৌরবজনক বৈশিষ্ট্যগুলো সঠিকভাবে ধরা পড়েনি। আমাদের প-িতদের মনোযোগও এসব বিষয়ে তেমনভাবে আকৃষ্ট হয়নি। আমরা তাই নিজেদের সোনার খনিকে উপেক্ষা করে অন্যদের কয়লা খনির মূল্য নির্ধারণেই অধিক ব্যস্ত রয়েছি এবং হীনম্মন্যতার শিকার হয়েছি। এই হীনম্মন্যতা জয় করতেই হবে। মানবজাতির শিক্ষক এই মহামানবের রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পর্যালোচনার আগে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ও অত্যন্ত সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। হেরা গুহায় তাঁর ধ্যানমগ্নতা, তারপর বাস্তবতার জগতে তাঁর প্রত্যাবর্তন, এক কথায়, পারমার্থিকতা এবং যুক্তির তথা আধ্যাত্মিকতা এবং কর্মনিষ্ঠার সুষ্ঠু সমন্বয় এই হলো এক দিকে যেমন তাঁর জীবনের সৌন্দর্য, তেমনি ইসলামের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান। মরমিবাদ দিয়ে যার শুরু, রাষ্ট্রের মধ্যে তার পরিপূর্ণতা। এই তো মানবজীবনের সারবত্তা। এই সারবত্তার বাস্তবরূপ হলেন আদর্শ মানব হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনী। এক অর্থে, এতো এক পরশমণি। তাঁর স্পর্শে সব কিছুই সোনা হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব যে অসাধারণ তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, মুসলিম বিশ্ব এই পরশমণির স্পর্শ থেকে আজ দূরে। যেকোনোভাবে হোক মুসলমানদের এই পরশমণির স্পর্শ লাভ করতেই হবে। লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com