মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন একজন মহান সমাজসংস্কারক। প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। গোত্র কলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি, সামাজিক বিশৃঙ্খলার নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল গোটা সমাজ।
সামাজিক সাম্য, শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, নারীর মর্যাদা ইত্যাদির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। জঘন্য দাসত্ব প্রথা, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, পাপাচার, অন্যায়-অত্যাচারের চরম তা-বতায় সমাজ কাঠামো ধসে পড়েছিল। ঠিক এমন এক দুর্যোগময় যুগে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আবির্ভাব। তিনি আরবের বুকে বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করে বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে নবুওতের আলোকে উদ্ভাসিত করেন।
ঐতিহাসিক রেমন্ড লার্জ বলেন, ‘The founder of islam is in fact the promoter to the first social and international revolution of which history gives mention.’ অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক বিপ্লবের সূচনাকারী হিসেবে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তকের নাম ইতিহাসে প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে।
মহানবী সা: সমাজের যাবতীয় অনাচার দূর করে যে এক জান্নাতি সমাজব্যবস্থা কায়েম করেন। নি¤েœ তার সংস্কারের সামান্য নমুনা পেশ করা হলো :
তাওহিদের আদর্শে সমাজের গোড়াপত্তন : ধর্মীয় ক্ষেত্রে নানা অনাচার, পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করে পুরো সমাজকে এক আল্লাহর বিশ্বাসী তথা তাওহিদের আদর্শে সমাজকে নবরূপে রূপায়িত করেন। সব ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের উৎস একমাত্র আল্লাহকেই মেনে নিয়ে সমাজের সব কর্মকা- পরিচালনা করার ব্যবস্থা করেন। মানবতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন : সমগ্র আরবদেশ যখন জঘন্য পাপ ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: সাম্য, অকৃত্রিম ভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্বমানবতার ভিত্তিতে যে এক উন্নত ও আদর্শ সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। তাঁর প্রবর্তিত সমাজে গোত্রের বা রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ঈমানের বন্ধনই ছিল মজবুত ও ঐক্যের প্রতীক। তিনি অন্ধ অভিজাত্যের গৌরব ও বংশ মর্যাদা নিয়ে গর্বের মূলে কুঠারাঘাত হানেন এবং সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ কাঠামো প্রস্তুত করেন। এই একটি মাত্র আঘাতেই আরবের একমাত্র বন্ধন গোত্রপ্রীতি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং ঈমান এই বন্ধনের স্থান দখল করল। ‘মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর সব দিকে অনুগত ও মানুষের সর্বাধিক কল্যাণকামী।’ (সূরা হুজরাত-১৩) তার সমাজব্যবস্থায় উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র, কালো-সাদার বৈষম্য রইল না। মানুষে মানুষে সব প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূরীভূত করে মানবতার অত্যুজ্জ্বল আদর্শে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন। আরবের ইতিহাসে রক্তের পরিবর্তে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের এটিই প্রথম দৃষ্টান্ত।
দাসপ্রথার উচ্ছেদ : আরবে বহু যুগ ধরে গোলামি প্রথা বা দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। মনিবরা গোলামদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করত। মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদাই ছিল না। তারা পশুর মতো জীবনযাপন করত। তাদের বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো। হজরত মুহাম্মদ সা: মনিবদের নির্দেশ দিলেন ক্রীতদাসদের প্রতি সদাচরণ করো। তোমরা যা খাও, পরিধান করো, তা তাদের খেতে এবং পরিধান করতে দাও। (মুসলিম-১৬৬১)
তিনি দাসদের মুক্তির পথনির্দেশ করে ঘোষণা দিলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিন দাসকে আজাদ করবে, আল্লাহ তায়ালা এর প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে আজাদকারীর প্রতিটি অঙ্গকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবেন। এমনকি এর (দাসের) লজ্জাস্থানের বিনিময়ে তার (মুক্তকারীর) লজ্জাস্থানকে মুক্তি দেবেন।’ (মুসলিম-১৫০৯, তিরমিজি-১৫৪১)
অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি একজন মুমিন দাসকে আযাদ করে দেবে, এর বিনিময়ে তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করে দেয়া হবে।’ (আবু দাউদ-৩৯৬৬)
তিনি অনেক দাসকে মুক্তি করে দেন এবং অনেক সাহাবি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তার উদারতার জন্য দাস বেলাল রা:-কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন এবং ক্রীতদাস জায়েদকে সেনাপতিত্বে বরণ করে দাসদের পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন।
নারীর মর্যাদা দান : তৎকালীন আরবে নারীদের ভোগ্য সামগ্রী মনে করা হতো। তারা ছিল পুরুষদের দাসীমাত্র। কন্যা সন্তানদের জীবন্ত দাফন প্রথা সিদ্ধ ছিল। পরিবারের কর্তা ইচ্ছে করলে নারীকে ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তর করতে পারত। পিতা এবং স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোনো অংশ ছিল না।
মহানবী সা: নারীদের সমাজে অভূতপূর্ণ মর্যাদা দিলেন। তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে সমমর্যাদা দিলেন।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তিকে কন্যা সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সাথে তা সম্পাদন করেছে সেই কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আবরণ বা প্রতিবন্ধক হবে।’ (তিরমিজি : ১৯১৩, ১৯১৫)
বিধবাদের সাহায্যকারীদের সম্পর্কে রাসূল সা: বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকিনের জন্য (খাদ্য জোগাতে) সচেষ্ট ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি সমতুল্য এবং যারা রাতে (নফল) ইবাদত করে ও দিনে সিয়াম রাখে তাদেরও সমতুল্য।’ (বুখারি-৫৩৫৩, মুসলিম-২৯৮২, নাসায়ি-২৫৭৭, তিরমিজি-১৯৬৯, ইবনে মাজাহ-২১৪০)
নবী সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম, আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীদের কাছে সর্বোত্তম ব্যক্তি।’ (ইবনে মাজাহ-১৯৭৭, তিরমিজি-৩৮৯৫)
আসওয়াদ রা: থেকে বর্ণিত- আয়েশা রা:-কে রাসূল সা: ঘরে তার স্ত্রীদের সাথে কী কী করতেন তা জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, ‘তিনি স্ত্রীদের কাজে সহযোগিতা করতেন, আর যখন নামাজের সময় হতো তখন তিনি নামাজে যেতেন।’ (বুখারি-৬০৩৯)
সঙ্ঘাতমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা : তৎকালীন আরবের বিভিন্ন গোত্রে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত লেগেই থাকত। সামান্য অজুহাতে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বাজে আর দীর্ঘকাল ধরে তা দাবানলের মতো জ্বলতে থাকত। রক্তপাত ও লুণ্ঠন ছিল তাদের নিত্যদিনের পেশা।
হজরত মুহাম্মদ সা: এ সব অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রাক-নবুওয়াত ‘হিলফুল ফুজুল’ এবং পরে ‘মদিনা সনদ’-এর মাধ্যমে সমাজে শান্তি আনয়ন করেন।
মদ্যপান রহিতকরণ : মদ্যপ্রিয়তা আরবদের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। নর্তকীদের সাথে মদোমত্ত হয়ে তারা যেকোনো অশ্লীল কাজ করত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: দেখলেন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনে চরম ক্ষতি সাধনকারী। তাই তিনি কঠোরভাবে মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সমাজের কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হন।
জুয়া খেলা নিষিদ্ধ : তৎকালীন আরবে জুয়া খেলার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং এটিকে সম্মানজনক অভ্যাস মনে করত। জুয়া খেলায় হেরে মানুষ অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতো। ফলে ব্যাহত হতো সামাজিক জীবন। হজরত মুহাম্মদ সা: জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সমাজকে ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন।
কুসিদ প্রথা উচ্ছেদ : কুসিদ প্রথা বলতে এক প্রকার সুদের কারবার প্রথা। আরব সমাজে জঘন্য কুসিদ প্রথা বিদ্যমান ছিল। তারা এত উচ্চহারে সুদের কারবার করত যে, সুদ পরিশোধ করতে না পারলে সুদগ্রহীতার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির সাথে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে নেয়া হতো। আরবে প্রচলিত ব্যবস্থা সুস্থ সমাজ বিকাশে প্রচ- বাধাস্বরূপ ছিল। নবীজী সা: সুদ হারাম ঘোষণা করেন এবং আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীকে ‘করজে হাসানা’ দানে উৎসাহিত করেন।
কুসংস্কার থেকে মুক্তি : আরবের জাহেলি সমাজে নানা কুসংস্কার ছিল। ভাগ্যনির্ধারক তীর, দেবদেবীর সাথে অলীক পরামর্শ, মৃতের অজ্ঞাতযাত্রার ধারণা প্রভৃতি চালু ছিল। শুধু তা-ই নয়, আরো নানা প্রকার ভূত-প্রেত, দৈত্য, পরী প্রভৃতিকে বিশ্বাস করত।
হজরত মুহাম্মদ সা: বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে তাদের মন-মগজ থেকে সব কুসংস্কার দূর করেন।
নিষ্ঠুরতার অবসান : প্রাচীন আরব নিষ্ঠুরতায় ভরপুর ছিল। ভোগবাদী আরবরা দাস-দাসী, এমনকি শত্রু গোত্রের লোকদের সাথে অমানবিক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিত। বিত্তবানরা খেলার ছলে দ্রুতগামী ঘোড়ার লেজের সাথে নারীকে বেঁধে দিত। যার ফলে হতভাগা নারীর প্রাণ-প্রদীপ নিভে যেত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: সমাজ থেকে এরূপ বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা দূর করে সমাজের আমূল পরিবর্তন আনেন।
জাকাতের বিধান জারি : অর্থনৈতিক দৈন্যদশা বিদূরীত করে সমাজের সার্বিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সৌধ নির্মাণের নিমিত্তে হজরত মুহাম্মদ সা: জাকাতের বিধান প্রবর্তন করেন। যাতে করে সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম হয়। তিনি ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য সমাজ থেকে চিরতরে উৎখাত করেন।
আর্থ-সামাজিক অসাধুতা দূর : মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: আর্থ-সামাজিক অসাধুতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, হটকারিতা, মজুদদারি, কালোবাজারি, ইত্যাকার যাবতীয় অনাচার হারাম ঘোষণা করে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করে একটি সুন্দর, পবিত্র সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ করেন।
জীবন-সম্পদের নিরাপত্তা : হজরত মুহাম্মদ সা: প্রতিটি মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেন। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং কারো সম্পদ গ্রাস করা যাবে না। সবার জীবন-সম্পদ পবিত্র আমানত এ বিশ্বাসের ওপর সমাজ কাঠামোকে গড়ে তোলেন।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : বিভিন্ন প্রকার অবিচার, অনাচার দূরীকরণের জন্য বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: আইনের শাসন কায়েম করেন। আইনকে ব্যক্তিবিশেষ অথবা কোনো গোত্রের হাতে না দিয়ে কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগের হাতে ন্যস্ত করেন। যেন আইন কারো ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার না হয়।
উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, হজরত মুহাম্মদ সা: অতি অল্পসময়ে স্বীয় প্রচেষ্টা অদম্য শক্তিবলে সব অনাচারের মূলোচ্ছেদ করে অসভ্য, দ্বিধাবিভক্ত সদা কলহপ্রিয় সে সময়ের সর্বাপেক্ষা অধঃপতিত আরবকে সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বন্ধনে সঙ্ঘবদ্ধ জাতিতে পরিণত করে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
এভাবেই তিনি পুরো বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। যার জন্য বলতে হয় হজরত মুহাম্মদ সা: সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ একজন আদর্শ, মহামানব ও আখেরি নবী। কিয়ামত পর্যন্ত যারা তার অনুসরণ করবে অবশ্যই তারা হেদায়েত পাবে। ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করবে। লেখক : শিক্ষক ও গবেষক