শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৯ পূর্বাহ্ন

ইসলামে মানবপ্রেম

ডা: মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মানুষের ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, ক্ষমতা, বংশ, রূপলাবণ্য আল্লাহ দেখেন না, তিনি দেখেন কোন মানবপ্রেমিক বান্দা তার সাধ্যানুযায়ী জনসেবা ও মানবতার কল্যাণ সাধন করছে কি না। তাই প্রত্যেক মানুষেরই পারস্পরিক মানবতাবোধ ও উদার নৈতিক মানসিকতা থাকা অপরিহার্য।
মানুষ সামাজিক জীব, একে অপরের ওপর নির্ভর করে এই পৃথিবীতে বসবাস করে। একে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া মানুষ একদিনও চলতে পারে না। তাই সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানবতা ও মানুষের কল্যাণে যা কুরআন কারিমে লিপিবদ্ধ হয়েছে। মুহাম্মাদ সা:-এর জীবন এবং তার কর্মের মধ্যে এই শিক্ষাগুলো পরিলক্ষিত হয়। ইসলাম হচ্ছে যা কুরআনে পালন করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং যেভাবে মুহাম্মাদ সা: তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। তাই, ইসলামসংক্রান্ত যেকোনো বিষয় বুঝতে হলে এই দু’টির (কুরআন এবং মুহাম্মাদ সা:-এর কর্ম) ওপর নির্ভর করতে হবে।
ইসলামে সামাজিক কল্যাণ
ইসলামী ঐতিহ্যে, সামাজিক কল্যাণের ধারণাটিকে প্রধান মূল্যবোধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে সামাজিক সেবা চর্চার বিষয়টিকে উৎসাহিত এবং নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একজন মুসলমানের ধর্মীয় জীবন অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায় যদি না তিনি মানবকল্যাণে অংশগ্রহণ না করেন। সমাজকল্যাণ ইসলামী ধারণা সম্পর্কে কুরআন এই আয়াতটি প্রায় সময় উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আর সৎকর্ম শুধু এটাই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে; বরং বড় সৎকাজ হলো ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব নবী-রসূলদের ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেজগার। (সূরা বাকারা-১৭৭)
একইভাবে, ইসলাম ধর্মে মাতা-পিতা, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, অসুস্থ, বৃদ্ধ এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকদের প্রতি দায়িত্বের কথা নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। হাদিসে কুদসিতে (পবিত্র হাদিস) বলা হয়েছে যে- আল্লাহ হাশরের দিন সেসব মানুষের ওপর অসন্তুষ্ট হবেন যারা অসুস্থ রোগীদের সেবা করেনি এবং যারা ক্ষুধার্তদের খাবার দেয়নি। এই হাদিসটি দ্বারা মানব সমাজকে অন্যের প্রয়োজনের সময় সাড়া দেয়ার বাধ্যবাধকতার বিষয়টিকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবাইকেই সামাজিক দায়িত্ব এবং সামাজিক কল্যাণ প্রচারের দায়িত্ব পালন করতে হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা শ্রেষ্ঠতম ওইসব উম্মত, যাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে মানবজাতির মধ্যে; তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ কর, আর আল্লাহর ওপর ঈমান রাখো এবং যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মুসলমান রয়েছে এবং অধিকাংশ কাফির।’ (সূরা আলে-ইমরান-১১০)
মানবপ্রেম ঈমানের অংশ
মুক্তির নিয়তে মানবসেবা নয়; বরং ইসলামের ফরজ হিসেবে করা চাই। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি যেমন শরিয়তে ফরজ, মানবসেবাও ফরজ। এ ফরজ আদায়ের নিয়তে মানবসেবা করতে হবে। যার সম্পদ আছে, সে সম্পদ দিয়ে মানুষের সেবা করবে। যার বুদ্ধি আছে, সে বুদ্ধি দিয়ে মানুষের সেবা করবে। যার শক্তি আছে, সে শক্তি দিয়ে মানুষের সেবা করবে। যার যতটুকু সাধ্য, সেভাবে সে মানুষের সেবা করবে। মানবপ্রেম ও মানবসেবার বিষয়টি এত খাটো করে দেখার বিষয় নয়; বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি ইসলামে মানবপ্রেমকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের কেউ পূর্ণাঙ্গ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ সে অন্য মুসলমানের জন্য তা ভালো না বাসবে, যা নিজের জন্য ভালোবাসে।’ (বুখারি-১৩) এ হাদিস থেকে বোঝা গেল, নিজের জন্য আমরা যা ভালোবাসি, আরেক মুসলমান ভাইয়ের জন্যও সেটি ভালোবাসতে হবে। নিজের জন্য যেমন চাই, অপরের জন্য যদি সেটি না চাই, তাহলে আমাদের ঈমান পূর্ণাঙ্গ হবে না। এমনকি মানবপ্রেম জান্নাতি হওয়ার লক্ষণ। জান্নাতিদের আলোচনায় আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তারা বলে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের আহার দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সূরা দাহর : ৮-৯)
দয়াকারীর ওপর আল্লাহ দয়া করেন
মানুষ নিজের জন্য কামনা করে, তার উন্নতি হোক, তার ধন-সম্পদ হোক, তার সুখ-শান্তি হোক, তার ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হোক, তার ছেলেমেয়েদের ভালো ঘরে বিয়ে হোক। প্রত্যেকে চায়, আমি যেন ভালো চাকরি পাই, আমি যেন ভালো পদ পাই, আমি যেন ইজ্জত-সম্মান পাই ইত্যাদি। আমরা প্রত্যেকে নিজের জন্য এগুলো ভালোবাসি। অতএব, অন্যের জন্যও এগুলো ভালোবাসতে হবে। আমি নিজের জন্য বিপদাপদ চাই না। তাই অন্যের জন্যও বিপদাপদ চাইতে পারব না। নিজের জন্য নিরাপত্তা চাই। তাই অন্যের জন্যও নিরাপত্তা চাইতে হবে। আমার মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য যেমন চেষ্টা করি, অন্যের জন্যও তেমন চেষ্টা করতে হবে। আমার কামনা হলো, অনাহারে যেন না থাকি। অতএব, অন্যের জন্যও তা চাইতে হবে। এক কথায়, সবাইকে নিজের মতো করে দেখতে হবে। সবার জন্য নিজের মতো করে চাইতে হবে। সবাইকে নিজের মতো করে ভাবতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অনেক বড় ব্যাপার। এমনকি একে ইসলামের অঙ্গ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমন না হতে পারলে আমরা মোমিন নই। রাসূল সা: বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ দয়ালুদের দয়া করেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া কর, তাহলে মহান আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’ (তিরমিজি-১৯২৪) রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি এতিম-অনাথের রক্ষণাবেক্ষণ বা লালনপালন করে, সে জান্নাতে আমার সাথে পাশাপাশি থাকবে।’ এ কথা বলে তিনি মধ্যমা ও তর্জনী আঙুল পাশাপাশি রেখে দেখান। (তিরমিজি-১৯১৮)
সৃষ্টির প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো
মানবসেবার কথা এত শক্ত করে আর কোনো ধর্মে বলা হয়নি। ইসলামে মানবপ্রেমের কথা এবং মানবসেবার কথা বেশি বলা হয়েছে। আমরা পুরোপুরি করতে পারি না বা করি না, সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু ইসলামে এটি বলা হয়েছে। আমলে না থাকলে সেটি ইসলামের দোষ নয়; বরং আমাদের দোষ। মানবপ্রেম ও মানবসেবা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অনেক ফজিলতের কাজ। মানবসেবার একটি ফজিলত হলো, মানবসেবা দ্বারা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত লাভ করা যায়। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের কেউ শুধু তার আমল দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ-৭৪৭৯) নেক আমলের পাশাপাশি আল্লাহর রহমত থাকলেই নাজাত পাওয়া যাবে। আল্লাহর রহমত লাভের সবচেয়ে সহজ পথ হলো- তাঁর সৃষ্টির প্রতি সহযোগিতা ও উপকারের হাত বাড়িয়ে দেয়া। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয়, যে মানুষের বেশি উপকার করে। তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নেক আমল হলো, কোনো মুসলমানের হৃদয়ে আনন্দ দেয়া, তার বিপদ-কষ্ট দূর করা, তার ঋণ পরিশোধ করে দেয়া, তার ক্ষুধা দূর করা।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৮/১৯১)
মানবসেবা নবীজীর বিশেষ গুণ
কুরআন মাজিদের সূরা ’আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাজিল হলে রাসূল সা: ভয় পেয়ে যান। তার প্রতি এটিই ছিল প্রথম অহি নাজিলের ঘটনা। উম্মুল মুমিনিন খাদিজা রা:-এর কাছে ফিরে এসে তিনি বললেন, ‘আমি নিজের ব্যাপারে শঙ্কা বোধ করছি।’ খাদিজা রা: বললেন, ‘আল্লাহর কসম, কখনো নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায়-দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারি করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।’ (বুখারি-৩)
মানবসেবার অপার প্রতিদান
রাসূল সা: বলেন, ‘মানবকল্যাণমুখী কাজ বিপদাপদ ও অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে। গোপন দান আল্লাহর ক্রোধ নির্বাপিত করে। রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় আয়ু বৃদ্ধি পায়।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৩/১১৫) রাসূল সা: আরো বলেন, ‘দুজন মানুষের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে ন্যায়-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করাকে দান বলে। কোনো মানুষকে তার বাহন পরিচালনা করতে সাহায্য করা দান বলে গণ্য। কারো বাহনে তার জিনিসপত্র তুলে দেয়া দান বলে গণ্য। সুন্দর আনন্দদায়ক কথা দান বলে গণ্য। মসজিদে গমনের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ দান বলে গণ্য। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক দ্রব্য সরিয়ে দেয়া দান বলে গণ্য।’ (বুখারি-২৯৮৯) এমনকি যেকোনো জীবজন্তুর সেবাতেই সাওয়াব রয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘যে কোনো প্রাণীর সেবাতেই তোমরা সাওয়াব পাবে।’ (বুখারি-২৩৬৩)
পরিশেষে বলতে চাই, মানুষের সেবা করা, মানবপ্রেম এমন এক আমল, যা দ্বারা আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায়। কেননা, সব সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক প্রিয়, যে আল্লাহর পরিবারের প্রতি অনুগ্রহ করে। যারা সৃষ্টিকে ভালোবাসে, সৃষ্টির সেবা করে, তারাই আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। আর যারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র, তাদের নাজাত পেতে কোনো বেগ পেতে হবে না। যখন নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি ইবাদতের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিয়ে পার হওয়া কঠিন হবে, তখন বিভিন্ন আমল নাজাতের ওসিলা হবে। এর মধ্যে সৃষ্টিসেবাও এক বিশেষ আমল; যা দ্বারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া যায়; যা মানুষের মুক্তির ওসিলা হবে। আল্লাহর প্রিয় হতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে মানুষকে ভালোবাসা দিতে হবে। আল্লাহর প্রেম অর্জন করতে হলে মানুষের প্রতি, সৃষ্টির প্রতি প্রেম নিবেদন করা চাই। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, মুসলিম-অমুসলিম সবার বিপদাপদে পাশে দাঁড়ানো ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর পবিত্র শিক্ষার অন্যতম। লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com