মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে: তারেক রহমান সন্দ্বীপে ৫০ বছরের মধ্যেও নিরাপদ যোগাযোগ গড়ে না ওঠা লজ্জার হাসিনা জোর করে রাইফেল দিয়ে ইতিহাস পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন: রিজভী ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সজাগ থাকার আহ্বান মির্জা আব্বাসের নতুন বছরের শুরুতেই ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতে চমক প্রাইম ব্যাংকের পেরোল ব্যাংকিং সেবা নেবে অসকার বাংলা কোম্পানি ইউনিয়ন ব্যাংকের নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদের ২৫তম সভা সেনাবাহিনী জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের পাশে থাকবে : সেনাপ্রধান বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার তদন্ত নিয়ে ব্রিটিশ এমপিদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা ‘তামিম একেবারে মৃত্যুর দরজায় ছিলেন’

ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য

মাসুম আলভী
  • আপডেট সময় সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ইসলাম গোটা মুসলিম জাতির মধ্যে ভাষা, বর্ণ আর রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে ধর্মীয় ঐক্যের বীজ বপন করেছে। মুসলিম উম্মাহ ধর্মীয় চেতনায় সবাই এক ও অভিন্ন হোক নারী-পুরুষ, পীর-মুরিদ, আলেম-মূর্খ, শাসক-শাসিত, ধনী-গরিব, কর্মকর্তা-কর্মচারী, যুবক-বৃদ্ধ। কালো আর সাদা বাইরে কেবল ভিতরের সবার সমান রাঙা। ইমাম রাগেব ইস্পাহানি রহ: তার ‘মুফরদাতুল কুরআন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘উম্মাহ বলা হয় এমন মানবগোষ্ঠীকে, যাদের মধ্যে কোনো বিশেষ কারণে সংযোগ ও ঐক্য বিদ্যমান। আর অধিকাংশ তাফসিরবিদ একমত যে, বিশেষ ঐক্য হলো ধর্মীয় ও জাতীয় স্বার্থে ঐক্য। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মদিনায় তার প্রতিফলন ঘটান। যেখানে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা আর কাজেকর্মে একতার ফলে মুসলিম উম্মাহের মধ্যে রুহানি পরিবেশ বিরাজ করত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর মুহাজিরদের আগমনের আগে যারা মদিনাকে নিবাস হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং ঈমান এনেছিল (তাদের জন্যও এ সম্পদে অংশ রয়েছে), আর যারা তাদের কাছে হিজরত করে এসেছে তাদের ভালোবাসে। আর মুহাজিরদের যা প্রদান করা হয়েছে তার জন্য এরা তাদের অন্তরে কোনো ঈর্ষা অনুভব করে না এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর তাদের অগ্রাধিকার দেয়। যাদের মনের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ (সূরা হাশর : ৯)
এ ছাড়াও মুসলিম-অমুসলিম সব মানুষ আদম সন্তান। তাই ইসলাম ধর্ম মানুষের অধিকার নিশ্চিতে গুরুত্ব প্রদান করেছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মদিনা সনদে স্পষ্ট ঘোষণা করেন, ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে জাতীয় স্বার্থের ব্যত্যয় ঘটতে পারে না। জনসাধারণের ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় জাতীয় স্বার্থ। যেখানে মানুষের জান ও মাল নিরাপদ এবং অপরাধ নিষিদ্ধ। একতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে সাহাবিদের ভ্রাতৃত্ববোধ এত প্রগাঢ় হয়ে ওঠে যে, একজন অপর ভাইয়ের জন্য ধনসম্পদ এবং প্রিয়জন ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করত না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের ওপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসার স ার করেছেন। এরপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে।’ (আল ইমরান : ১০৩)
মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের উৎস একত্ববাদের বিশ্বাস। ইবাদতের ঐক্যস্বরূপ সমগ্র দুনিয়ার মুসলমান আল্লাহর ঘর কাবা শরিফের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করে। পবিত্র হজের মৌসুমে মক্কায় হজ পালন করে। সব মুসলমান একই কুরআন ও হাদিস পাঠ করে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর রেখে যাওয়া আদর্শের অনুসারী সবাই, তবে আজকে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে ফাটল কেন? আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনগুলো আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর আজাব।’ (আলে ইমরান : ১০৫)
ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা একটি দেহের মতো আর মুসলমানদের গৌণ বিষয়ে মতানৈক্য, দল, উপদল, ফেরকা দেহের বিষফোঁড়া। যা যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যে ক্ষতবিক্ষত করছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় যারা তাদের দীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোনো ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব নেই। তাদের বিষয়টি তো আল্লাহর কাছে। এরপর তারা যা করত, তিনি তাদের সে বিষয়ে অবগত করবেন।’ (সূরা আনআম: ১৫৯) মুসলিম উম্মাহের ধর্ম পালন পদ্ধতি আহলে হাদিস, কেয়ামি, মাজহাবপন্থী, তাবলিগি, পীরবাদী, সুফিবাদী, জামাতপন্থী, কট্টর শরিয়তপন্থী, কট্টর মারেফতপন্থী, মৌলবাদী, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে মতভেদ হলেও একত্ববাদ, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, জান্নাত, জাহান্নামসহ মৌলিক বিষয়ে সবাই একতম। তাই কুরআন ও হাদিসের সিদ্ধান্ত ছাড়াই মতানৈক্য ও বিতর্কিত বিষয়ে ধর্মীয় প-িত ও নেতাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয় এই বোধে সবাই বিশ্বাসী হলে মুসলমানদের ঐক্য মজবুত হবে।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ফাটলের পেছনে ধর্মনিরপেক্ষবাদ ও ভিন্ন ধর্মের গভীর ষড়যন্ত্র। কারণ তারা জানে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের সব পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যাবে। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সাথে মুসলমানদের দা-কুমড়া সম্পর্ক। উপমহাদেশে বিভিন্ন ফেরকা, অন্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক ভিন্ন নীতির কারণে যুদ্ধ ও আন্তঃকোন্দলে বিশেষ করে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, পূর্ব-তিমুর, নাইজেরিয়া, সুদান, কসোভোতে নিজ দেশে মুসলমানরা উদ্বাস্তু। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো এবং পরস্পর ঝগড়া করো না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য ধরো, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’ (সূরা আনফাল : ৪৬) মুসলমানদের ওপর ভিন্নধর্মীদের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এক সময়ে অর্ধপৃথিবী শাসন করা জাতিকে দাসে পরিণত করেছে। এই মহাবিপদে মুসলিম উম্মাহর বিবেক কি একবারের জন্য হলেও নাড়া দেয় না? তারা কি চায় না? মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে সুখ-শান্তি। মুসলিম জাহানে শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রভুত্ব এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের সোনালি সময় আবার ফিরে আসুক?
মুসলিম উম্মাহের প-িতদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞান ও দার্শনিক জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে ঘোড়ার দীর্ঘ রেসে বারবার হেরে যাচ্ছে। ঐক্যের দীর্ঘ রেসে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন ধর্মীয় প-িতদের জাগতিক লোভ পরিহার ও ঐক্যবদ্ধ থাকার দৃঢ়সঙ্কল্প। প্রজ্ঞাবানদের আল্লাহ তায়ালা দ্বীন প্রচারের জন্য বাছাই করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদের মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০) মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে প্রয়োজন সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, দেশীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন, মিডিয়াতে আলোচনা, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা। আর শরিয়া বোর্ড গঠন করে বিতর্কিত ও মতানৈক্য বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের আলোকে এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত করা। ধর্ম কেবল মসজিদ আর উৎসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হলে অন্যায়, জুলুম, দুর্নীতি জাদুঘরে যাবে। এটা রাজনীতিবিদরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন। যেমন মদিনা রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধান ও সবচেয়ে দুর্বল লোকের জন্যও সমবিধান ছিল। এজন্য রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আর ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার চিন্তা যেন না করতে পারে, সেজন্য কিছু জ্ঞানপাপী ধর্মীয় প-িতকে ব্যবহার করে ইসলামী ঐক্য বিনষ্ট এবং ধর্মীয় ফায়দা হাসিলের ধান্ধা করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায় তাদের মুখের (ফুঁক) দ্বারা, কিন্তু আল্লাহ তো তাঁর নূর পরিপূর্ণ করা ছাড়া অন্য কিছু চান না, যদিও কাফিররা অপছন্দ করে।’ (সূরা তাওবা : ৩২) আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:-এর মাধ্যমে ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের রীতিনীতির দুনিয়ার বুকে দেখিয়েছেন। সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহাবিদের ত্যাগ ছিল অতুলনীয়। কিন্তু আজকে মুসলিম উম্মাহর ক্রান্তিলগ্নে আলেম সমাজ নির্জীব। তবে মাঝে মধ্যেই ঐক্যের বুলি আওড়াতে দেখা যায় কিন্তু কাজের বেলায় শূন্য। মাতৃভূমির শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় নিজেদের চিরচেনা খোলস ভেদ করে ধর্মীয় চেতনা ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে আলেম সমাজের রাজনৈতিক ঐক্য গঠন সময়ের দাবি।
মুসলিম উম্মাহর চতুর্দিকের গভীর ষড়যন্ত্রের জাল ধ্বংস করতে পারস্পরিক উদারতা ও পরমতসহিষ্ণু হওয়া প্রয়োজন। ভিন্ন দল, ভিন্ন পথ হোক মতপার্থক্য কিন্তু ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থ সর্বপ্রথম বিবেচনায় নেয়া উচিত। কারণ অবিচার, দুর্নীতি, ব্যাপক নির্যাতনে মুমিনরা ক্লান্ত প্রায়। এক বুক আকাক্সক্ষা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের দিকে তাকিয়ে আছে। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে আমাদের রব, আমাদের বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।’ (সূরা নিসা : ৭৫)
মুসলিম উম্মাহর আকাশে, হেরার আলোতে বিদঘুটে অন্ধকার ঢেলে দেয় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। আর মুসলিম উম্মাহ ভুলে গেছে বিদায় হজের ভাষণ। কুরআন ও হাদিস থেকে বিচ্যুতি গভীরতম ক্ষতের সৃষ্টি করেছে উম্মাহর ঐক্যে। তাই আজ মানবতা ভূলুণ্ঠিত। আইন আদালত নির্বাসনে। মহাদুর্যোগে মুসলিম উম্মাহ স্ব^তঃস্ফূর্ত হয়ে ঐক্যের ডাক না দিলে আসমান থেকে ঐক্যের বার্তা আসবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের জন্য রয়েছে, সামনে ও পেছনে, একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হেফাজত করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। (সূরা রা’দ : ১১)
লেখক : প্রাবন্ধিক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com