গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের ঘোষণা আগামী সপ্তাহেই আসতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অন্তর্র্বতী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ থেকে দেশে এলেই হয়তো ঘোষণাটি আসবে। গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর সার্কিট হাউস রোডে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদকসহ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তথ্য উপদেষ্টা এ কথা বলেন। সভায় সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা গণমাধ্যমের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে সেগুলো সমাধানের দাবি জানান। তাঁদের অনেকেই ডিএফপি থেকে করা সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যার সত্যতা নিয়ে অভিযোগ করেন। এ সময় স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠনের দাবিও তোলা হয়। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই, অবশ্যই। কিন্তু আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমা কতটুকু? আমরা জানি, স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতাই; এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ চলে না। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে বা স্বাধীনতার মাধ্যমে ফ্যাসিস্টদের প্রচারণা করা যাবে কি না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে ফ্যাসিস্টদের পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্য সাধন) করা যাবে কি না। সেই বিষয়টি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম। আমরা আমাদের দেশ, আমাদের এই যে অভ্যুত্থান, সেটিকে প্রাধান্য রেখে, মানদণ্ড রেখে সব স্বাধীনতা কিন্তু নিশ্চিত করতে চাই।’ তথ্য উপদেষ্টা বলেন, তাঁরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চান; এটি কেবল মুখের কথা নয়, এটি কাজে বাস্তবায়ন করতে চান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলার সময় সংবাদপত্রের একটি ভালো ভূমিকা ছিল। একটা সময় সারা দেশের মানুষ সংবাদপত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। কারণ, কিছুটা তথ্য পেলে পত্রিকাতেই পাওয়া যায়। তখন দেখা গেছে, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম একেবারেই কুক্ষিগত, সেই সময়ে সংবাদপত্রই ছিল একমাত্র ভরসা। এ জন্য তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান। তবে উল্টো দিকও ছিল মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, সংবাদকর্মীদের অনেকেই আন্দোলনের বিপক্ষেও ছিলেন। ফ্যাসিবাদের পক্ষে তাঁরা কাজ করেছেন। এ সময় নিজের আগের একটি বক্তব্যের পুনরুল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ফ্যাসিবাদের পক্ষে যাঁরাই কাজ করুন না কেন, গণহত্যাকে যাঁরাই উসকানি দিয়ে থাকুক না কেন, তাঁদের বিচার হবে। সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকÍএটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না। আবার একই সঙ্গে কোনো সাংবাদিক বা যে কেউ, তাঁর সঙ্গে যদি অবিচার করা হয়, সেই বিষয়টিও দেখা হবে। কাউকে যদি এমন মামলা দেওয়া হয়, যে মামলায় আসলে অভিযুক্ত হওয়ার মতো নয়, সেই মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হবে। যাঁর যতটুকু অভিযোগ, সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মতবিনিময় সভায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। এসব বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। বিজ্ঞাপন ও বিল দেওয়ার পুরো ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করার প্রক্রিয়া চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মতবিনিময় সভায় মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সংবাদপত্রের সমস্যার সমাধান করতে চাইলে কমিশনের কোনো বিকল্প নেই। গণমাধ্যমের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই ক্রান্তিকাল যাচ্ছে মন্তব্য করে যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, খুব কষ্টের মধ্যে আছে গণমাধ্যম। বিশেষ করে করোনাকাল থেকে এর যাত্রা শুরু। প্রচারসংখ্যা, বিজ্ঞাপন ভাটির দিকে। সবাই মিলে গণমাধ্যমের জন্য একটি নীতিমালা করতে হবে।
কালের কণ্ঠ সম্পাদক হাসান হাফিজ বলেন, সংস্কার শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে করলে হবে না, এই চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরও অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। এখানেও অনেক কারচুপি, প্রতারণা ও জালিয়াতি আছে বলে অভিযোগ আছে। এখানেও সংস্কার করতে হবে। ডিএফপি থেকে করা প্রচারসংখ্যা নিয়ে অভিযোগ করেন হাসান হাফিজ। তিনি এসব অনিয়ম দূর করার দাবি জানান।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমেও বনিয়াদি সংস্কার দরকার। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত করে, এমন আইনগুলোও সংস্কার করা উচিত। সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা আনা দরকার। কমিশন করে অংশীজনদের সঙ্গে বসে কথা বললে কাজের কাজ হবে বলে মত দেন সাজ্জাদ শরিফ। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা অন্যান্য সংবাদপত্রের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরাও মতামত তুলে ধরেন। এ ছাড়া তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো. নিজামূল কবীর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আকতার হোসেন, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক মো. মাহবুবুল আলম, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবদুল্লাহ প্রমুখ বক্তব্য দেন।