শেরপুরে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানি নামতে থাকায় দৃশ্যমান হয়ে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। বন্যায় ভেঙেছে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট ও ডুবে গেছে ফসলি জমি। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে বন্যাকবলিতরা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা থাকলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার-বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সেইসাথে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, চুলকানিসহ পানিবাহিত রোগ। সরেজমিনে নকলা উপজেলার পিছলাকুড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ভোগাই নদীর তীরে জেলেপল্লীতে প্রায় ১৫০ পরিবারের বসবাস। নদীর বাঁধ ভেঙে পাহাড়ি ঢলে ওই এলাকার অনেকের বাড়ি-ঘর, জিনিসপত্র, ফসলি জমি সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে।
ছয় দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় গ্রামের ভেতর দিয়ে চলাচলের জন্য পিছলাকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তাড়াকান্দা পর্যন্ত দেড় কিলোমিটারের একমাত্র কাঁচা রাস্তাটি ঢলের পানিতে জায়গায় জায়গায় ভেঙে গর্ত হয়ে গেছে।
ওই গ্রামের অহল্লা রানী বর্মণ বলেন, ‘বাড়িঘরে বন্যার পানি। পাঁচ থেকে ছয় দিন পর পানি নামছে। পানি থাকার সময় এক দিন সেনাবাহিনীরা এক প্যাকেট খিচুরি, আরেকদিন আধাকেজি মুড়ি দিয়েছিল। তিন দিন ওইগুলাই খাইয়া, না খাইয়া থাকছি। পানি থাকায় এক রকম কষ্ট আর এখন পানি নামার পরে আরেক রকম কষ্ট।’
বাদল চন্দ্র বর্মণ জানান, ঋণ নিয়ে ১০ শতাংশ জমিতে শসা ক্ষেত করেছিলেন। তিন দিন পরই শসা তোলা শুরু হতো। প্রায় এক লাখ টাকার মতো আয়ের আশা ছিল। ঢলের পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে।
তিনি আরো জানান, শসা ক্ষেত ছাড়াও পাঁচ শতাংশ জমিতে মরিচ চাষ, তিন কাঠা (২১ শতাংশ) জমিতে লাল শাক ও ১৮ কাঠা (১২৬ শতাংশ) জমিতে আমন ধানের আবাদ করেছিলেন। পাহাড়ি ঢলে সব ফসল ধ্বংস হয়ে গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমি দেখিয়ে বাদল বলেন, ‘বাড়িও গেছে, ফসলও গেছে। আমি এখন সর্বহারা। ফসল তুইল্লা ঋণধার শোধ তো দূরের কথা, এখন নতুন কইরা ঋণের জালে পড়লাম। সরকার যদি এহন সহায়তা না করে, তাহলে আমি এক্কেবারে শেষ। কিন্তু সরকারের কোনো লোক তো দেখতেও আসলো না, আমরা বাঁইচ্চা আছি, না কি মইরা গেছি।’ ঢলে ভেঙে পড়েছে বিধবা বানেছা বেগমের একমাত্র থাকার ঘরটি। ভেসে গেছে সব জিনিসপত্র। সব হারিয়ে শূন্য ভিটায় বসে থাকা বানেছা বেগম বলেন, ‘আমার তো আর কিছু নাই। আমি এখন এই ভাঙা ঘর কিভাবে করব কিছুই জানি না। আমার তো কোনো উপায় নাই। যদি কেউ আমারে সাহায্য না করে, আমার তো কোনো গতি নাই।’
গৃহবধূ কিরণ মালা বর্মণ বলেন, আমার বয়সে এত পানি দেখি নাই। বন্যার পানি আমাদের যে ক্ষতিটা করেছে, এখন আমরা কিছুই করতে পারছি না। আমরা এখন খুব কষ্টে আছি, চিন্তায় আছি। সরকার থেকে আমাদের কিছু না করলে আমরা দাঁড়াতেই পারব না।
জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক হিসাব মতে, বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এবার এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ছয় হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও আমন, সবজি চাষ এবং আদা ও কৃষি ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টাকার অংকে প্রায় ৫২৪ কোটি টাকার মতো ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে মৎস্য সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকার। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এজিইডি) রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১৩ কোটি টাকার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী তীর রক্ষা বাঁধ ও বেড়িবাঁধ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের সড়ক অথবা ব্রিজ, কালভার্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক শ’ কোটি টাকার। জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেছেন, বন্যাকবলিতদের মধ্যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। কেউ অভুক্ত থাকবে না। উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিভাগ, সংস্থা, সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ত্রাণ তৎপরতা চলছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাথমিক একটি তালিকা তৈরি করে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই পুনর্বাসন কাজ শুরু হবে।
সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, ডায়রিয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনী, মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, চিকিৎসকসহ চারটি মেডিক্যাল টিম ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তায় কাজ করছে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর দাবি, এখন ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি পুনর্বাসন সহায়তা খুবই প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে তাদের জন্য কিছু করা উচিত।