আর্থিক অনিয়ম, স্কুলের সম্পদ আত্মসাৎ, লুটপাট, সেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেও বহাল তবিয়তে আছেন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ঐহিত্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বড়লেখা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (টিটিসি)-এর প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস। শিক্ষক রঞ্জিত কুমার বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছেন। তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির সক্রিয় সমর্থক হওয়ায় এতোদিন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তা। ইতিপূর্বে তার নানা অপকর্ম নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বড়লেখায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে গাছ বিক্রির অভিযোগ শিরোনামে জাতীয় গণমাধ্যম দৈনিক যুগান্তর ১৪ নভেম্বর ২০২১-এ সংবাদ প্রকাশ করে। একই দিন সিলেটের প্রাচীনতম সংবাদ মাধ্যম দৈনিক জালালাবদ-এ বড়লেখায় স্কুল ভবনের বেইজ বসানোর অজুহাতে অতিরিক্ত গাছ বিক্রির অভিযোগ শিরোনামে আরো একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন নিউজপোর্টালে তার অনিয়ম-দুর্নীতি উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এদিকে ২৫ নভেম্বর ২০২১-এ শিক্ষক রঞ্জিত কুমারের অনিয়ম, দুর্নীতির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে এলাকাবাসী ও অভিভাবকবৃন্দ একটি অভিযোগপত্র জমা দেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষা বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন অসাদু কর্মকর্তার সাথে সিন্ডিকেট করে নানা অনিয়ম দুর্নীতি শুরু করেন। বিভিন্ন বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার অনিয়ম-দুর্নীতি। তৎকালীন সরকারের ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায় নির্বিঘেœ নিজের অপকর্ম চালিয়ে গেছেন। বৈষম্য বিরুধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও বহাল তবিয়তে আছেন হাসিনা সরকারের দোসর-সমর্থক প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস। শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, বড়লেখা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস ২০২০-২১ অর্থ বছরে রুটিন মেইনটেনেন্স বাবদ ৪০ হাজার টাকা ও প্রাক প্রাথমিক বাবদ ১০ হাজার মোট ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পান। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে পান আরো ৫০ হাজার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রায় ৮০ লাখ টাকা ব্যায়ে ১টি নতুন ভবন এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রায় ১৪ লাখ টাকা ব্যায়ে ১টি নতুন ওয়াশ ব্লকও বুঝে পান। ২৩-২৪ অর্থ বছরে রুটিন মেইনটেনেন্স, প্রাক প্রাথমিক এবং ওয়াশ ব্লক বাবদ আরো ১ লাখ টাকা বরাদ্দ পান। রুটিন মেইনটেনেন্স বাবদ প্রাপ্ত ৮০ হাজার এবং ওয়াশ ব্লকের ২০ হাজার টাকার যথাযথ ব্যবহার নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পিআইও অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে স্কুল মাঠে মাটি ভরাট বাবদ (স্থানীয় এমপির বরাদ্দ থেকে) দুই ধাপে ১ লাখ ২ হাজার টাকা বরাদ্দ পান। বাস্তবে মাটি ভরাটের কোনো কাজই হয়নি বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্কুল মাঠে মাটি ভরাট প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এই প্রকল্পের গঠিত কমিটির সভাপতি প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস নিজে হওয়ায় এতে জবাব দিহিতার কিছু রইল না। তাছাড়া তিনি উপর মহলকে ম্যানেজ করে চলতে বেশ পটু। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিভাবক জানান, স্কুলের সামনের সড়ক প্রশ্বস্ত করণে স্কুলের সীমানা প্রাচির ভেঙে ফেলেছেন পৌর কর্তৃপক্ষ। ভাঙা দেয়ালের মালামালগুলো (ইটের কংক্রিট, পুরাতন রড, লোহার তৈরী গেইট) সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই গোপনে বিক্রি করে সেচ্ছাচারিতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অভিযোগ ওঠেছে রাস্তা প্রশ্বস্ত করণে স্কুল যে জায়গাটুকু ছেড়ে দিয়েছে তাতে লাগানো স্কুলের মালিকানাধীন বড় বড় কয়েকটি গাছসহ স্কুল মাঠের একটি বড় কদম গাছসহ বেশ কয়েকটি গাছ পৌর মেয়রের সাথে আতাত করে বিক্রি করে দেন। এছাড়াও টিনের চালা বিশিষ্ট পুরাতন স্কুল ঘর নিলামের পর প্রায় ৭টি কক্ষের ডেস্ক, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিলসহ ১২টি ফ্যান গোপন স্থানে সরিয়ে নেন। যার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। অভিভাবকরা বলেন, প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার বেশির ভাগ সময় উপজেলা শিক্ষা অফিসে সময় কাটাতেন। স্কুলে সময় কম দিতেন। পাঠদান থেকেও নিজেকে বিরত রাখতেন। এসব অনিয়ম নিয়ে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে উল্টো রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে হুমকি-ধামকি ও নানাভাবে হয়রানি করতেন প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস। স্কুলের সীমানা প্রাচির ভেঙে সড়ক বড় করার ফলে স্কুলটি এখন উন্মোক্ত হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলের সামনের সড়কটি এখন মরন ফাঁদ বলে মনে করেন অভিভাবকরা। একাধিক অভিভাবক এবং এলাকাবাসি শিক্ষক রঞ্জিত কুমারে যাবতীয় অপকর্মের যথাযত তদন্তের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রাপ্ত অভিযোগগুলোর বিষয়ে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস। শিক্ষা অফিস সূত্রে প্রাপ্ত বরাদ্দের টাকা কিভাবে এবং কোথায় খরচ করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষা অফিস থেকে আমি কোনো বরাদ্দ পাইনি। স্থানীয় এমপির বরাদ্দ থেকে প্রাপ্ত টাকা স্কুল মাঠ ভরাটের কাজে ব্যয় হয়েছে। স্কুলের গাছ কাটা, আসবাবপত্র বিক্রয়, সীমানা প্রাচীর ভাঙা, মাঠি ভরাট এগুলোর কোন বিষয়ে আপনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেননি রঞ্জিত কুমার। বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন কোন বিষয় আমি মৌখিক ভাবে শিক্ষা অফিসকে জানিয়েছি। বড়লেখা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাসের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অবগত করলে তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মীর আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পুরাতন ডেস্ক-বেঞ্চ থেকে আমি ১৬ জোড়া ডেস্ক-বেঞ্চ মুছেগুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে দিয়েছি। এছাড়া আর কোনো বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা কিংবা আমাকে জানানো হয়নি।