শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ পূর্বাহ্ন

তাড়াতাড়িই বাড়ি ফেরার কথা বলেছিল সাহাদাত, ফিরেছে লাশ হয়ে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

চলতি বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন দিবস। সরকার পতনের খবর শুনে সেদিন কিশোর সাহাদাত বিজয় মিছিলে যোগ দেন। এর আগে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময়ে নানীকে বলে গেছেন, তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরবেন। ফিরেছেন সাহাদাত। তবে লাশ হয়ে। নানাবাড়িতে মানুষ। তাই সেদিন থেকে নানীর কান্না যেন বাঁধ মানছে না। জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট বিকেলে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার সামনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন সাহাদাত হোসেন (১৬)। ছোট বেলা থেকেই নানার বাড়িতে বড় হয়েছেন এই কিশোর। শহিদ হওয়ার পরে দাফনও হয়েছে ওই বাড়িতে। শাহাদাতের নানি মমতাজ বেগম কাঁদতে কাঁদতে বার বারই বলছেন, ‘বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বলেছে ‘নানু আমি খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। নানু আমার ফিরেছে। কিন্তুলাশ হয়ে। শেষবারের মত আর কথা হয়নি নাতির সাথে।’ পারিবারিক কারণে ছোট বেলা থেকে অবহেলিত নাতি আমার শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলো পরপারে। সম্প্রতি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পূর্ব ইউনিয়নের বালিথুবা গ্রামের বেপারীতে গিয়ে কথা হয় সাহাদাতের স্বজনদের সাথে। ওই বাড়ির সামনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাকে।
কথা বলে জানা গেছে, সাহাদাতের মা শিরতাজ বেগমের সাথে প্রথমে বিয়ে হয় বরিশালের খলিলুর রহমানের সাথে। বিয়ের পর থেকেই বাবার বাড়িতেই থাকতেন শিরতাজ। পরে কর্মের জন্য চলে যান ঢাকা। সাহাদাতের জন্ম হয় নানা বাড়িতে। পারিবারিক কলহের কারণে স্বামী শিরতাজকে ছেড়ে চলে যায়। পরে কয়েকবছর অপেক্ষা করে স্বামীকে তালাক দেন শিরতাজ। এরপর আবার বিয়ে হয় লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার বাসিন্দা আমির হোসেনের সাথে। আমির হোসেন পেশায় কবিরাজ। শিরতাজ বিয়ের পর স্বামীর সাথে থাকতে শুরু করেন।
এ কারণে বেশিরভাগ সময় নানির কাছেই বড় হয়েছেন শহিদ সাহাদাত হোসেন। নাতির মৃত্যুর বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন নানি মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, তার মা শিরতাজ আমার মেয়ে। নাতির জন্ম হয়েছে আমাদের বাড়িতে। সাত বছর বয়সে তাকে চাঁদপুরে একটি কওমী মাদ্রাসায় পড়তে দেই।
সেখানে দুই বছর পড়ার পরে চলে আসে বাড়িতে। এরই মধ্যে মেয়ের বিয়ে হয় খলিল কবিরাজের সাথে। এরপর তাদের চান্দ্রা বাড়িতে কিছুদিন তাদের সাথে ছিলো আমার নাতি। ওই বাড়িতে একা থাকতে সমস্যা হওয়ার কারণে আমার কাছে চলে আসে। এরপর কয়েকবছর আমাদের বাড়িতেই ছিলো।
তিনি বলেন, সাহাদাতের বয়স ১৬ হলেও নাতি আমার দেখতে অনেক সুন্দর ও লম্বা হয়েছে। কিছুদিন আগে কাজ নেয় ফরিদগঞ্জ শহরে একটি কাপড়ের দোকানে। সেখানে কাজ করত এবং মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে এসে থাকত। সর্বশেষ ২ আগষ্ট আমাদের বাড়ি থেকে ফরিদগঞ্জ কাজে চলে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে বলে, নানু আমি সোমবার বাড়িতে আসব। কিন্তু নাতি আমার এসেছে লাশ হয়ে। কিভাবে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারিনি। সাহাদাতের মামা সোহাগ হোসেন ব্যাপারী বলেন, গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ফরিদগঞ্জ থেকে লোকজন ফোন করে জানায় আপনার ভাগিনা সাহাদাত মাথায় গুলি খেয়ে গুরুতর আহত হয়েছে। খবর শুনে সন্ধ্যার পরে তার মা শিরতাজসহ চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চলে যাই। সেখানে তাকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, লোকজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি শেখ হাসিনার পতনের খবর শুনে লোকজন মিছিল নিয়ে নামে। ওই মিছিলে সাহাদাতও ছিলো। থানার পাশে মন্দিরের সামনে সাহাদাত পুলিশের গুলিতে আহত হয়।
তিনি আরও বলেন, সাহাদাতের লাশ রাতেই বাড়িতে নিয়ে আসি। পরদিন সকালে বাড়ির সামনে নামাজে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। গত এক সপ্তাহ আগে সাহাদাতের লাশ ময়না তদন্তের জন্য কবর থেকে তোলা হয়। থানা পুলিশ এসে তার বিষয়ে তদন্ত করে। তদন্ত শেষে আমরা নিজেরা তার লাশ দাফন করি।
সাহাদাতের নানা কলিম উল্লাহ ব্যাপারী বলেন, আমার নাতি খুবই দুর্ভাগা। সে ঠিক মত তার বাবা মায়ের আদর পায়নি। তাদেরকে রেখে বাবা চলে গেছে অন্যত্র। মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার নাতির শাসন কিংবা আদর করার একান্ত কেউ ছিলো না। আমারা গরিব। কৃষি কাজ করে সংসার চলে। যতটুকু সম্ভব নাতিকে লালন পালনের চেষ্টা করেছি।
তিনি আরও বলেন, সাহাদাত শহিদ হওয়ার পরে এ পর্যন্ত অনেক লোকজনই এসেছে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল বিএনপির এম এ হান্নান ও লায়ন হারুনর রশীদ কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। আর ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন থেকে আমাদেরকে ১০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দিয়েছে। আমার এই ছোট নাতিকে কেন গুলি করে হত্যা করা হলো আমি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এর বিচার চাই।
সাহাদাতের সৎ পিতা আমির হোসেন কবিরাজের (৬০) সাথে মোবাইলে কথা হলে জানান, আমার বিয়ের পরে মাঝে মাঝে সে আমাদের কাছে থেকেছে, আমি যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করেছি। আমাদের ফরিদগঞ্জের বাসায় আসতো, আমি নিজেই তাকে ফরিদগঞ্জ বাজারের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ নিয়ে দিয়েছি।
সাহাদাতের মা শিরতাজ বেগম (৪০) এর সাথে মোবাইলে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা খুব অসহায় ছিল। তার আসল পিতা শাহাদাত আমার পেটে আসার ছয় মাস পর থেকেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার জন্য আট বছর অপেক্ষা করে আমি পরে আবার বিয়ে করেছি। কিন্তু আমাকে ছেলেসহ বিয়ে করার জন্য বর্তমান স্বামীর আগের সন্তানরা বাড়িতে উঠতে দেয় না। তাই বিভিন্ন জায়গায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। এখন ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকি। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে ছেলেটাকে ঠিকমত পড়াতেও পারিনি। হেফজু খানায় দিয়েছিলাম। কিন্তু সে মনোযোগী না হওয়ায় সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছে। মাত্র কাজ শিখতে দোকানে চাকরি নিয়েছিলো। এই ছেলেটা ছিল আমার সম্বল। এখন তাকে ছাড়া আমি কি নিয়ে বাচঁবো বলেন?
আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। দোষীদের শাস্তি চাই। সরকারের কাছে সহায়তা চাই। আমার ঘরবাড়ি কিছু নেই। বাবা মার সাথেও বিরোধ। স্বামীর আগের সন্তানদের সাথেও বিরোধ। এই অবস্থায় কই যাবো আমি? সরকারের কাছে তাই আমার আবেদন, আমাকে সাহায্য করুন। সহায়তা ছাড়া আমার বেঁচে থাকার কোন উপায় নাই।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com