ইসলামিক ব্যাংকিং হলো এমন একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা যা ইসলামী শরিয়াহ আইন বা ইসলামী অর্থনৈতিক নীতিমালার অধীনে পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে সুদ (রিবা) নিষিদ্ধ, অতিরিক্ত ঝুঁকি এড়ানো হয় এবং হারাম খাতে অর্থ বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকে। এতে সম্পদভিত্তিক এবং লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগির মডেলের মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালনা করা হয়, যাতে ন্যায়, সততা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বজায় থাকে। অন্যদিকে, সাধারণ ব্যাংকিং এমন একটি প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যা সুদের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এবং বিভিন্ন আর্থিক সেবা প্রদান করে, যেমন- আমানত সংগ্রহ, ঋণ প্রদান এবং বিভিন্ন বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা। এই ব্যবস্থায় ব্যাংক মূলত সুদের মাধ্যমে আয় করে এবং নির্দিষ্ট সুদের হারে ঋণ প্রদান করে, যা ঋণগ্রহীতাকে নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করতে হয়।
ইসলামিক ব্যাংকিং এবং সাধারণ ব্যাংকিংয়ের মধ্যে মূল পার্থক্য রয়েছে তাদের পরিচালনার নীতিমালায়। ইসলামিক ব্যাংকিং পরিচালিত হয় শরিয়াহ বা ইসলামী আইনের অধীনে, যেখানে সুদ (রিবা), অতিরিক্ত ঝুঁকি এবং অনৈতিক ব্যবসায় নিষিদ্ধ। ইসলামিক ব্যাংকিং সাধারণ ব্যাংকিংয়ের তুলনায় বেশি লাভজনক কি না, তা নির্ভর করে বিশেষ কিছু উপকারিতা এবং সীমাবদ্ধতার ওপর। নিচে দু’টি ব্যাংকিং ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে ব্যাখ্যা করা হলো :
নৈতিক বিনিয়োগ : ইসলামিক ব্যাংকিং শরিয়াহ অনুসারে পরিচালিত হয়, যেখানে বিনিয়োগ কেবল সমাজের উপকারী খাতে করা হয় এবং হারাম খাতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। সাধারণ ব্যাংকিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট নৈতিক সীমাবদ্ধতা নেই, তাই সব ধরনের লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে পারে, তা সে অনৈতিক হোক বা না হোক। নৈতিক ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ায় ইসলামিক ব্যাংকিং পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য লাভজনক হতে পারে।
ঝুঁকি ভাগাভাগি বনাম ঝুঁকি স্থানান্তর : ইসলামিক ব্যাংকিং : ইসলামিক ব্যাংকিং ঝুঁকি ভাগাভাগির নীতিতে কাজ করে, যেমন মুদারাবা বা মুশারাকা পদ্ধতিতে ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়ে লাভ ও ক্ষতির অংশীদার হয়। সাধারণ ব্যাংক ঋণ দিয়ে সুদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ করে, গ্রাহকের প্রকল্প লাভজনক না হলেও ব্যাংক সুদ পায়। ঝুঁকি ভাগাভাগির কারণে ইসলামিক ব্যাংকিং অধিকতর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক স্বার্থ বজায় রাখে।
সুদমুক্ত কাঠামো : ইসলামে সুদ হারাম হওয়ায় ইসলামিক ব্যাংকিং সুদমুক্ত, যেখানে ব্যাংক মুনাফা ভাগাভাগি বা নির্দিষ্ট চার্জের মাধ্যমে আয় করে।
সাধারণ ব্যাংকিং : ঋণ প্রদান করে সুদের মাধ্যমে আয় করে, যা অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সুদমুক্ত হওয়ায় ইসলামিক ব্যাংকিং অর্থনৈতিক চাপ কমায় এবং আরো ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা প্রদান করে।
আর্থিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রভাব : শরিয়াহ আইন অনুযায়ী, ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে বাস্তব সম্পদ-নির্ভর বিনিয়োগ করা হয়। ফলে উচ্চ ঝুঁকির বিনিয়োগ এড়িয়ে চলে। ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ এবং ডেরিভেটিভসের মতো জটিল আর্থিক পণ্য ব্যবহার করে, যা অস্থিতিশীলতার কারণ হতে পারে। ইসলামিক ব্যাংকিং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়।
গ্রাহক সম্পর্ক ও স্বচ্ছতা : স্বচ্ছতা ও ন্যায়সঙ্গত আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, যার ফলে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে বিশ্বাস এবং পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর হয়। সাধারণ ব্যাংকে নির্দিষ্ট সুদ থাকায় তারা তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকি নিয়ে থাকে এবং গ্রাহকের প্রকল্পের সাথে সরাসরি জড়িত নয়। ইসলামিক ব্যাংকিং গ্রাহকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও বিশ্বাস বজায় রাখে যা দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে পারে।
লাভক্ষতি ভাগাভাগি নীতি : ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে লাভ-ক্ষতির নীতির ভিত্তিতে বিভিন্ন অর্থায়ন প্রক্রিয়া রয়েছে, যেমন মুদারাবা এবং মুশারাকা। মুদারাবায় ব্যাংক মূলধন দেয়, আর গ্রাহক কাজ করে এবং লাভ ভাগাভাগি হয়। ক্ষতির ক্ষেত্রে, ব্যাংক মূলধনের ঝুঁকি বহন করে। সাধারণ ব্যাংকে লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগি হয় না। ব্যাংক ঋণ দিয়ে সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত আয় পায়, ফলে ক্ষতির সব ঝুঁকি গ্রাহকের ওপর পড়ে। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগি নীতি উদ্যোক্তাদের ঝুঁঁকি কমিয়ে দেয় এবং অর্থনৈতিক সাফল্যে ব্যাংক ও গ্রাহকের পারস্পরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
সম্পদনির্ভর অর্থায়ন : ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের প্রায় সব লেনদেনই বাস্তব সম্পদ বা সেবার সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, মুরাবাহায় ব্যাংক কোনো পণ্য কিনে সেটি গ্রাহকের কাছে একটি নির্দিষ্ট লাভে বিক্রি করে, ঋণ প্রদান করে না। ফলে সব লেনদেন বাস্তব সম্পদের ভিত্তিতে হয়। সাধারণ ব্যাংক ঋণ প্রদান করে, যা সম্পদ বা প্রকৃত লেনদেনের সাথে সরাসরি সংযুক্ত নয়। এর ফলে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটে। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সম্পদনির্ভর অর্থায়ন ঝুঁকি কমায় এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সহায়তা করে।
দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এবং মূল্য : ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ এড়িয়ে, ইসলামিক ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প এবং স্থায়ী বিনিয়োগে মনোযোগ দেয়। বাস্তব অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এটি আরো স্থিতিশীল এবং ঝুঁকিমুক্ত। সাধারণ ব্যাংকিং : সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ডেরিভেটিভস ও অন্যান্য উচ্চ-ঝুঁকির পণ্য ব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
উপকারিতা : ইসলামিক ব্যাংকিং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে এবং অস্থিরতার ঝুঁকি কমায়।
গ্রাহক সুবিধা ও ঋণ ব্যবস্থাপনা : সুদের প্রতি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের অতিরিক্ত ঋণের ঝুঁকি কম থাকে। এতে গ্রাহকদের সহায়ক ঋণ কাঠামো প্রদান করে, যেখানে তারা সুদের কারণে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে বাধ্য নয়। ঋণে সুদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে গ্রাহকদের ঋণের বোঝা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে, বিশেষত ব্যক্তিগত ঋণ এবং ক্রেডিট কার্ডে। ইসলামিক ব্যাংকিং গ্রাহকদের ঋণের ওপর চাপ কমায় এবং একটি ন্যায্য ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সহায়ক হয়।
ব্যাংকিং ফি ও খরচ : ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে সুদ না থাকায়, বিভিন্ন সেবার জন্য প্রাথমিক ফি বেশি হতে পারে। শরিয়াহ মেনে বিনিয়োগ পণ্য তৈরি করতে বেশি খরচ হয়। প্রাথমিক খরচ কম হলেও সুদের কারণে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ খরচ সৃষ্টি হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে ইসলামিক ব্যাংকিং সাশ্রয়ী হতে পারে, কেননা সুদের মাধ্যমে বাড়তি খরচ যুক্ত হয় না।
সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং অর্থনৈতিক প্রভাব : ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য সামাজিক দায়িত্ব পালন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি। এটি ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসা অর্থায়নে প্রাধান্য দেয়, যার ফলে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর সহায়তা হয়।
সাধারণ ব্যাংকিং : সাধারণ ব্যাংক লাভের কথা ভেবে পরিচালিত হয়, তাই যেখানে লাভ বেশি, সেসব খাতে বিনিয়োগ করে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ওপর বিশেষ জোর দেয় না।
উপকারিতা : ইসলামিক ব্যাংকিং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও দারিদ্র্য দূরীকরণের ভূমিকা পালন করে।
শেয়ারহোল্ডারদের লাভ ও ঝুঁকি : ইসলামী ব্যাংকগুলো সাধারণত শেয়ারহোল্ডারদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থিতিশীল লাভ প্রদান করে। এটি ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ কাঠামোর কারণে বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক।
সাধারণ ব্যাংক উচ্চ ঝুঁকির বিনিয়োগে বেশি লাভ করতে পারে, যা স্বল্পমেয়াদে বেশি আয় এনে দেয় কিন্তু স্থিতিশীল নয়। যারা স্থিতিশীল এবং ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ চায়, তাদের জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং উত্তম।
ইসলামিক ব্যাংকিং কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যাংকিংয়ের তুলনায় লাভজনক হতে পারে, বিশেষত যখন এটি স্থিতিশীলতা, ঝুঁকি ভাগাভাগি এবং নৈতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গ্রাহককে সুবিধা দেয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে গ্রাহকদের কাছে বেশি লাভজনক হতে পারে, বিশেষত যারা নৈতিক, সুদমুক্ত এবং স্থিতিশীল ব্যাংকিং কাঠামো পছন্দ করেন। তবে যাদের দ্রুত লাভ বা বহুমুখী বিনিয়োগ প্রয়োজন, তাদের জন্য সাধারণ ব্যাংকিং উপযুক্ত হতে পারে। এই কারণে, ইসলামী ব্যাংকিং এবং সাধারণ ব্যাংকিংয়ের লাভজনকতা মূলত গ্রাহকের প্রয়োজন, আর্থিক লক্ষ্য এবং নৈতিকতার ওপর নির্ভরশীল।
সারসংক্ষেপ; ইসলামিক ব্যাংকিং সাধারণ ব্যাংকিংয়ের তুলনায় কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে লাভজনক, যেমন-সামাজিক নৈতিকতা বজায় রাখা, ঝুঁকি ভাগাভাগি, এবং সুদমুক্ত নীতির ফলে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতা। ইসলামিক ব্যাংকিং এমন গ্রাহকদের জন্য বেশি লাভজনক, যারা নৈতিক এবং স্থিতিশীল ব্যাংকিং কাঠামো খোঁজেন। লেখক : শিক্ষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ