শীতের আগমনের সাথে সাথে ভোলা জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে রং-বেরঙের নানান প্রজাতির অতিথি পাখিদের মেলা বসতে শুরু করেছে। শীতের অতিথি পাখিদের এমন আগমনে প্রকৃতির রুপে ভিন্ন শোভা যোগ করে। নভেম্বর প্রথম থেকে অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করে। মার্চের প্রায় শেষ পর্যন্ত থাকে। চরগুলোর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় অতিথি পাখিদের বিচরণ। সাগর-নদী, চর আর সবুজ গহীন বনের সমাহারে কান পাতলেই শোনা যায় পাখিদের কিচির-মিচির আওয়াজ। শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ডানা ঝাপটে পাখিদের উড়ে বেড়ানো যেকারো মন ভোলায়। ভোর হলেই জেলার বিচ্ছিন্ন ডুবোচর গুলোতে পাখিদের ডুব সাঁতার, দল বেঁধে খাবার সংগ্রহ অথবা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ানো দেখা যায়। সুদূর সাইবেরিয়া, তিব্বত, মোঙ্গলীয়াসহ বিভিন্ন বরফে ঢাকা এলাকা থেকে প্রতিবছর শীতের প্রথমেই বছরের এ সময়টাতে ভোলায় অতিথি পাখিদের আগমন ঘটে। এসব পাখির কিচির-মিচির ডাক ও খনুসুটি প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ করে তুলে। বিশ্বের অনেক বিপন্ন পাখিরও আগমন ঘটে এ সময়।
বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষা ঢালচর, মনপুরা, কলাতলীর চর, চর কুকরী মুকরী, চর শাহজালাল, চর শাজাহান, চর পিয়াল, আইলউদ্দিন চর, চরনিজাম, চর পাতিলা, ডেংগারাচর সহ মেঘনা-তেঁতুলিয়ার উপকূলবর্তী মাঝের চর, চর চটকিমারা, মদনপুরা সহ বিভিন্ন চরে পাখিদের এমন দৃশ্য দেখা যায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের আহ্বায়ক পাখি পর্যবেক্ষক মোঃ বাহাউদ্দিন বলেন, বার্ডস ক্লাব সহ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবছরই ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকায় পাখি শুমারি করে থাকেন। এ অঞ্চলের মধ্যে পাখিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভোলা। এখানে বিশ্বের বিপন্ন অনেক পাখি দেখা যায়। এ সময়টাতে সাইবেরিয়া, তিব্বতসহ বিভিন্ন এলাকা বরফে ঢেকে থাকায় পাখিদের খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে দীর্ঘ আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। আবার তারা কিছুদিন থেকে চলে যায়। বাহাউদ্দিন জানান, সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ি উপকূলীয় এলাকাতে ৫৮ প্রজাতির অতিথি পাখি দেখা গেছে। এদের মধ্যে চামচ ঠুটো বাটন, ইন্ডীয়ান স্কিমার, ইউরোশিয়ান উত্তরের লেঞ্জাহাঁস, নার্ন সেভেলার, ইউরশিয়ান উইজন, ব্লাক হ্যাডেট আইভিজ পাখি, সৈকত পাখি টার্ন, পালাসস গার্ল, গ্রীল সাংক, রেড সাংকসহ বিভিন্ন দুর্লভ পাখির দেখা পাওয়া যায়। সাধারণত এসব চরে জুলফি পানচিল, গাঙ্গচিল, সোনাজিরিয়া, উত্তরের লেঞ্জাহাঁস, কালোলেজ জৌরালি, ইউরেশিও গুলিন্দা, ধূসর মাথা টিটি, সিথি হাঁস, খুন্তে হাস, খয়রা চখাচোখি, ছোট পানকৌরী, ছোট বগা, বড় বগা, পিয়ঙ হঁাঁস, ধূসর বগা, পাতি হাঁস, কালো মাথা গাঙচিল, ছোট ধলাজিরিয়া, ছোট নর্থ জিরিয়া, গো বগা, মেটে রাজ হাঁস, পাতি বাটান, চেগা, পাতি চেগাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বেশি দেখা যায়। এ পর্যবেক্ষক গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, চরাঞ্চলে বসতি নির্মাণ, চারণ ভূমি সংকট আর শিকারীদের কারণে পাখিদের আগমন ক্রমশই কমে যাচ্ছে। পাখি শিকার বন্ধ এবং জনগণকে আরো বেশি সচেতন করা না গেলে অতিথি পাখিরা হারিয়ে যাবে। ভোলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ তোতা মিয়া বলেন, এই অতিথি পাখি গুলো শীত প্রধান দেশ থেকে আমাদের দেশে মেহমান হিসেবে আসে। এরা আসার সময় সাথে করে বিভিন্ন বিপন্ন ও বিদেশী প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে আসে। যা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশাল অবদান রাখছে। তাই আমাদের সকলের উচিত এই অতিথি পাখির সুরক্ষা নিশ্চিত করা। যদি কেউ এ পাখি গুলো কে শিকার করে তাহলে তাদের কে আইনের আওতায় আনা হবে। উপকূলীয় বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, প্রতিবছরের মত এ বছরেও আমাদের চরগুলোতে বিপুল পরিমাণ অতিথি পাখির আগমন ঘটছে। এখানকার চরগুলো অতিথি পাখিদের জন্য বিখ্যাত। এসব পাখিদের কেউ যাতে বিরক্ত বা শিকার করতে না পারে সে জন্য রেঞ্জ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ও ভিট অফিসারদের নেতৃত্বে আমরা ইতিমধ্যেই টহল টিম গঠন করেছি। প্রতিটি রেঞ্জ থেকে টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়াও অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণে সাধারণ জনগণ বাধাগ্রস্থ না করে এজন্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক সভা সেমিনার এর কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি। যদি কোন শিকারি অতিথি পাখি শিকার করে তাহলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২ এর অধীনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।