ইসলামের দৃষ্টিতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ইসলাম সব মানুষকে সমান মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছে, যা বিশেষভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার, প্রতিবেশীর অধিকার এবং সমতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। কুরআন ও হাদিসের আলোকে এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা তুলে ধরা হলো : ১. সংখ্যালঘুদের অধিকার : ইসলাম ধর্মে সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমরা নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার লাভ করে।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না তাদের সাথে সদাচরণ করতে এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে যারা তোমাদের ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাসস্থান থেকে বের করেনি। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালোবাসেন।’ (সূরা: আল-মুমতাহিনা: ৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা সেসব অমুসলিমের সাথে সদাচরণ করতে যেন পিছিয়ে না থাকে, যারা তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা বা যুদ্ধে লিপ্ত নয়। এটি ইসলামের উদারতা ও সহনশীলতার নির্দেশ দেয়।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না; আর জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (সহিহ বুখারি : ৩১৬৬)। এই হাদিসে স্পষ্টভাবে জান্নাতে প্রবেশের শর্ত হিসেবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
২. প্রতিবেশীর অধিকার : ইসলামে প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক নির্দেশনা। প্রতিবেশীর অধিকার সংরক্ষণে জোর দেয়া হয়েছে, কারণ তাদের সাথে মানুষের দৈনন্দিন যোগাযোগ বেশি হয়ে থাকে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করো এবং তার সাথে কাউকে শরিক করো না; পিতামাতা, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন, নিকট প্রতিবেশী, দূরবর্তী প্রতিবেশী ও সাথীদের সাথে সদাচরণ করো।’ (সূরা আন-নিসা: ৩৬)
এই আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করার জন্য, যা ইসলামের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘জিবরাইল আ: আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে এতই উপদেশ দিয়েছেন যে, আমি মনে করেছিলাম প্রতিবেশীও উত্তরাধিকারী হয়ে যাবে।’ (সহিহ বুখারি : ৬০১৫)
এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, প্রতিবেশীর অধিকার সংরক্ষণ ইসলামে কতটা গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এমনকি এর মাধ্যমে একে পারিবারিক অধিকার বলেও মনে করা হয়েছে।
৩. সমতা : ইসলাম সব মানবজাতির মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করে জাতি, বর্ণ ও বংশ নির্বিশেষে সবাইকে সমান মর্যাদা দেয়। একজনের ওপর আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করা হয় শুধু তাকওয়া বা আল্লাহভীতি দিয়ে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানবম-লী! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সব কিছুর খবর রাখেন।’ (সূরা আল-হুজরাত : ১৩)
এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, জাতি-বর্ণের পার্থক্য মানবজগতের একটি বৈচিত্র্য, যা পরিচয়ের জন্য; এতে কোনো মর্যাদাগত ভেদাভেদ নেই। রাসূলুল্লাহ সা: বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘হে মানবম-লী! তোমাদের রব একজন আর তোমাদের পিতা একজন। আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং অনারবের ওপর আরবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তবে কেবল তাকওয়ার মাধ্যমেই শ্রেষ্ঠত্ব হতে পারে।’ (মুসনাদ আহমাদ)
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: সব মানুষের মাঝে সমতার ঘোষণা করেছেন, যা ইসলামের মর্মবাণী। ইসলাম হিংসা-বিদ্বেষ এবং সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একটি আলোকিত সমাজের শিক্ষা দিয়ে থাকে। মোটকথা, ইসলাম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার, প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ ও সমতার মতো মূলনীতির মাধ্যমে এ বিষয়গুলোকে শক্তিশালী করেছে। লেখক : শিক্ষক, জামি’আতুল আবরার ঢাকা