আজ শহীদ বাবরী মসজিদ দিবস। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদে অবস্থিত ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদটি ধ্বংস করে দেয়। এতে অংশ নেয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং শিব সেনা। বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পর শুরু হওয়া দাঙ্গায় ২ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। ১৫২৮ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট জহিরউদ্দীন বাবরের নির্দেশে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তার নামানুসারে এটিকে বাবরী মসজিদ বলা হতো।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিজেপি নেতা এল কে আদভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটি, ওমা ভারতীসহ হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ দেড় লাখ উগ্র হিন্দুদের ইয়ে হামলায় চালিয়ে মসজিদটি গুড়িয়ে দেয়। ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত। এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন। রায়ে আরও বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক। কিন্তু ২০১১ সালের ৯মে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ রায়ে স্থগিতাদেশ দেয়। এবং ২০১৯ সালে এক বিতর্কিত রায়ে মসজিদের জায়গাটি হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের জন্য দিয়ে দেয় ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট।
ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতৃ সিংহাসনে আরোহন করেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেন। এরপর কয়েকটি পর্যবেক্ষণমূলক অভিযানে সফলতা লাভের পর ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের সর্বশেষ সুলতান ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি সালতানাতের স্থলে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
মোগল সাম্রাজ্য
মোগল সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রাথমিক আধুনিক সাম্রাজ্য। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে পশ্চিমে সিন্ধু অববাহিকার বাইরের প্রান্ত থেকে, উত্তর-পশ্চিমে উত্তর আফগানিস্তান এবং উত্তরে কাশ্মীর, পূর্বে বর্তমান আসাম ও বাংলাদেশের উচ্চভূমি এবং এর উচ্চভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দক্ষিণ ভারতের দাক্ষিণাত্যের মালভূমি।
বাবরি মসজিদ নির্মাণ
মোগল শাসকদের আমলে ভারতবর্ষে অংখ্য শিল্প, স্থাপত্য গড়ে উঠে। মোগলস্থাপত্যের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য হলো স্থাপত্যে গম্বুজের ব্যবহার। সম্রাট জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর ১৫২৭ সালে অযোধ্যার নিয়ন্ত্রণ নেন তার সেনাপতি মীর বাকি। পরের বছর ১৫২৮ সালে সম্রাট বাবরের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সরযূ নদী পাড়ে নির্মাণ করেন তিন গম্বুজবিশিষ্ট এক মসজিদ। সাড়ে চার শতক পরে যা ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠে।
সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ নির্মাণের ৩৫৭ বছর পর ১৮৮৫ সালে মসজিদটি নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক ও আইনি লড়াই। তিন গম্বুজওলা ওই মসজিদ শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান ভেঙেই তৈরি হয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন হিন্দুদের একটা বড় অংশ। তারা বলতেন, মসজিদের ভেতরে থাকা একটা উঁচু বেদীর মতো অংশেই রাম ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, মোগল আমলে একাধিকবার ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা হয়েছিল। যদিও সেই দাবির সমর্থনে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণও মেলেনি।
বাবরি মসজিদ বিতর্ক
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে মহন্ত রঘবীর দাস নামের একজনের দায়ের করা এক মামলার পর সেনাপতি মীর বাকি নির্মিত বাবরি মসজিদ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। তৎকালীন ব্রিটিশ আদালত মহন্ত রঘবীর দাসের দায়ের করা মামলা খারিজ করে দেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ২২ডিসেম্বর রাতে বাবরি মসজিদে রাম ও সীতা মূর্তি রেখে আসে অজ্ঞাতনামা কোন হিন্দু উগ্রবাদী। এ ঘটনাকে অলৌকিক দাবি করে প্রার্থনা শুরু করে মন্দিরপন্থীরা। এ ঘটনার পর ১৯৫০ সালে মসজিদে তালা দেয় ভারতীয় আদালত। সাথে বন্ধ করে হিন্দুদের মূর্তি দর্শন।
১৯৫৯ সালে হিন্দুদের পক্ষে জমি চেয়ে মামলা করেন নির্মোহী আখড়া নামের এক ব্যক্তি। অপরদিকে ১৯৬১ সালে মসজিদের জমির মালিকানা দাবি করে মুসলমানদের পক্ষে আদালতের দ্বারস্থ হন উত্তর প্রদেশ মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড। ১৯৮০-র দিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তাদের রাজনৈতিক সহযোগী কট্টোর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা ওই স্থানে রাম মন্দির নির্মানে প্রচারাভিযান চালায়।
১৯৮৬ সালে আদালত মসজিদের তালা খোলার নির্দেশ দিলে ১৯৯০ সালে এ প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে বেশ কিছু শোভাযাত্রা ও মিছিল বের করে লাল কৃষ্ণ আদভানি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি দেড় লাখ কর সেবক নিয়ে একটি শোভাযাত্রা বের করে। এ শোভাযাত্রা চলাকালীন সময়ে উগ্রবাদী হিন্দুরা সহিংস হয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত এ মসজিদটি শহীদ করে। যা মুসলমানদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। পরবর্তীকালের অনুসন্ধানে এই মসজিদ ভাঙার অপরাধে ৬৮ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে, যাদের অধিকাংশই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপির নেতা বলে জানা যায়।