ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌর শহরের সন্ধ্যা নামলেই দেখা মিলবে সবজির ব্যাগ ভর্তি এক তরুণী ও তার স্বামীকে দোকানে দোকানে ও পথচারীর কাছে ফেরি করে নানা ধরনের শাকসবজি বিক্রি করতে। ওই তরণী তার বাড়ির আঙ্গিনা এবং লিজ নেওয়া অল্প পরিমাণ জমিতে উৎপাদিত বিষমুক্ত বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বাজার মূল্যে একজন দক্ষ বিক্রয় কর্মীর ন্যায় ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে প্রতিনিয়তই বিক্রি করছেন। টাটকা বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বিক্রি করে তিনি প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন। ৭ সদস্যের পরিবারে তরুণীর কষ্টার্জিত অর্থ চাহিদা পূরণে যথেষ্ট না হলেও কোনোমতে দিন চলে যাচ্ছে তাদের। জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী এই তরুণীর নাম সাফিয়া খাতুন। তিনি পৌর এলাকার বলিদাপাড়া গ্রামের সুগার মিল বাবরা রোড এলাকার সাইফুজ্জামান এর মেয়ে। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যায়নরত সময়ে ২০১৩ সালে সাফিয়া ভালোবেসে বিয়ে করেন শামীম হোসেন নামের এক সহপাঠীকে। ভালোবেসে বাধা সংসার ভালোই চলছিল তার। সংসদ জীবনে সময় অতিবাহিত হতে না হতে মাতৃত্বের স্বাদও পান তিনি। হন দুই সন্তানের জননী। হঠাৎ করে স্বামীর অসুস্থতা সংসার জীবনের সকল হিসেব-নিকেশকে নিমিষেই বদলে দেয়। দুঃসময়ে স্বামী সন্তান নিয়েও ঠাঁই হয় না বগুড়ায় সাফিয়ার শশুর বাড়িতে। অগত্য ২০১৮ সালে বাধ্য হয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে ফিরতে হয় বাবার বাড়িতে।কর্মহীন বৃদ্ধ বাবার ঘরে মাথা গোজার ঠাই পেলেও জীবন জীবিকা নিয়ে দু:শ্চিন্তার ভাজ পড়ে সাফিয়া খাতুনের কপালে। কিভাবে চলবে স্বামী, স্কুল পড়ুয়া সন্তান, বাবা-মা ও নানীকে নিয়ে তার সংসার। একদিকে এতগুলো মুখের খাবার জোগাড় করা অপরদিকে বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ এবং অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার মত কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় সাফিয়া। শিক্ষিত এই তরণী তখন আর কোন উপায় না পেয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় এবং বাড়ির কাছাকাছি লিজ নেওয়া কিছু জমিতে শুরু করেন বিষমুক্ত সবজি চাষ। একই সাথে হাঁস মুরগিও পালা শুরু করেন তিনি। সাফিয়া তার বাড়ির আঙিনায় এবং লিজকৃত জমিতে লাল শাক, পালং শাক, কলমি শাক, সবুজ শাক, সজিনা শাক, কচু শাক, পুঁইশাক, মরিচ, টমেটো, লাউ পেঁপে, ঢেঁড়স, পুদিনা পাতা, লেটুস পাতা, ডাটা, পেঁয়াজ ও রসুন উৎপাদন করেন সম্পূর্ণ কীটনাশকবিহীন প্রাকৃতিক উপায়ে। উৎপাদিত এসব শাকসবজি প্রতিদিন বিকেলে ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেন নিজের হাতে। এরপর দুই প্যাকেট ভর্তি করে স্বামীকে সাথে নিয়ে বাজারে বের হন তা বিক্রি করতে। প্রায় বছরখানেক ধরে এভাবেই শাকসবজি বিক্রি করায় নিয়মিত কিছু ক্রেতাও তৈরি হয়েছে সাফিয়ার। যে কারণে প্রতিদিন যে শাকসবজি নিয়ে তিনি বাজারে যান তার সবটাই বিক্রি হয়ে যায়। বিষমুক্ত সাফিয়ার উৎপাদিত শাক সবজির চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সংকট থাকায় সাফিয়া তার কৃষিকাজ অর্থাৎ শাকসবজি উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না। ফলে বাড়ছে না তার আয়ও। যে কারণে তার সংসারের চাহিদা অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। আর এভাবেই অভাব অনটনে অনেক সময় অর্ধহারে অনাহারে দিন কাটে সাফিয়ার। সাফিয়ার নিকট থেকে নিয়মিত সবজি কেনেন মিলন হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, মেয়েদের শাকসবজি হকারি করে বিক্রি করতে আমি কখনো দেখিনি। অল্প বয়সের এই মেয়েটির নিজের উৎপাদিত বিষমুক্ত শাকসবজি আমি কিনে খেয়ে দেখলাম, বাজারের থেকে স্বাদে ভিন্নতা আছে। অনেকে দেখি তার কাছ থেকে শাকসবজি কিনেছেন। বাজার মূল্যে টাটকা এবং বিষমুক্ত শাকসবজি কিনতে পেরে আমিও খুশি। সাফিয়া খাতুনের স্বামী শামীম হোসেন জানান, শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার কারণে আমি কাজ করতে পারি না। যে কারণে সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকি। নিজে আয় করতে না পারাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে বেশ কষ্টই দিন যায়।আমার স্ত্রীর সাফিয়া সংসার চালানোর খরচ যোগাতে খুব পরিশ্রম করেন। অসুস্থ থাকায় আমাকে নিয়মিত বেশকিছু টাকার ওষুধ খেতে হয়। আমার স্ত্রীর শাকসবজির চাষ এবং তা বাজারে বিক্রি করার ক্ষেত্রে আমি সাথে থেকে সহযোগিতা করে থাকি।আমরা যদি আরো কিছু জমিতে একটু বেশি পরিমাণে বিষমুক্ত শাকসবজি চাষ করতে পারতাম তাহলে তা বিক্রি করে আমাদের সংসারও ভালোভাবে চলত। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সংগ্রামী নারী সাফিয়া খাতুনের সাথে বিষমুক্ত শাকসবজি চাষ ও ফেরি করে তা বিক্রির ব্যাপারে কথা হলে তিনি বলেন, জীবন জীবিকার তাগিদে অনেকটা বাধ্য হয়েই স্বামী, সন্তান ও সংসারের দিকে তাকিয়ে সবজি চাষ ও তা ফেরি করে বিক্রির কাজ শুরু করি। লেখাপড়া শিখেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অভীষ্ট লক্ষ্যে আমি পৌঁছাতে পারিনি। তাই অল্প কিছু জমিতে শাক সবজির চাষ ও হাঁস মুরগি পালন করে যা আয় করি তা দিয়ে কোনরকমে চলে যাচ্ছে আমার। বেশি বেশি বিষমুক্ত কৃষি পণ্য উৎপাদন করে তা বাজারজাত করার ইচ্ছা আছে আমার। অনলাইনেও আমি বিষমুক্ত সবজি বিক্রি করতে চাই। কিন্তু অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে আমি তা করতে পারছি না। তবে কেউ যদি আমাকে এ কাজে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতেন তাহলে আমি আরো এগিয়ে যেতে পারব বলেও বিশ্বাস করি। তাতে করে আমার সংসারটাও ভালোভাবে চলে যেতো। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব আলম রনি বলেন, বিষমুক্ত প্রাকৃতিক উপায়ে সবজি বিক্রি করা সংগ্রামী ওই নারীর ব্যাপারে আমরা খোঁজ খবর নিয়ে কৃষি প্রণোদনার মাধ্যমে তার কাজে সহায়তা করব। কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, সাফিয়াকে আমরা ঋণ দিয়ে সহায়তা করতে পারি। পাশাপাশি আমার দপ্তরের সেসব সুবিধা তিনি পাওয়ার যোগ্য সেগুলো আমরা তাকে দেওয়ার চেষ্টা করব। কালীগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা তাসলিমা বেগম বলেন,সাফিয়া খাতুনের সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনে আমরা তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাই। তার আত্মনির্ভরশীলতার পথকে আরো বেগবান করতে আমার দপ্তরের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।