শাক-সবজির দামের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হলো গরমের সময়ের তুলনায় শীতকালে ব্যয় করতে হয় কম অর্থ। তবে এবার, শীতের আমেজ রাজধানীর কাঁচাবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঠাণ্ডা করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে শীতের আগাম সবজির সরবরাহ বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু দামে লাগাম আসছে না। ছোট ছোট ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম প্রতিটি ৩০ থেকে ৫০ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা। শিমের কেজি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। ক্রেতারা ‘অব্যবস্থাপনার’ জন্য দায়ী করছেন সরকারকে। তাদের অভিযোগ, নগরীর বড় বাজারগুলোতে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই দাম ঠিক করে দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন যে কোভিড মহামারির কারণে সরবরাহ কম থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যে ঊর্ধ্বগতি বজায় রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মালিবাগ বাজারে শিম, শালগম ও নতুন আলু কেজি প্রতি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা এবং মাঝারি আকারের প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। এছাড়া বেগুন, মুলা ও বরবটির কেজি চাওয়া হয় মানভেদে ৭০ থেকে ১০০ টাকা। কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, শসা, ঝিঙে, ঢ্যাঁড়স ও পটোলের দামও কম নয়, কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। প্রতি আড়াই শ’ গ্রাম কাঁচা মরিচের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা। একইভাবে, দাম বেড়ে প্রতি কেজি গাজর ৮০-১০০ টাকা, এক হালি কাঁচা কলা ৪০-৫০ টাকা এবং এক হালি ডিম ৪০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৫৫০-৫৬০ টাকা, খাঁসির মাংস ৭৫০-৯০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৩০-১৪০ টাকা এবং দেশি জাতের মুরগি ৪৫০-৫০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। তবে বিক্রেতারা জানান, শীত যত বাড়বে, শীতের সবজির সরবরাহ তত বাড়তে থাকবে। তখন দাম কমবে। বাজারে পুরোনো আলুর কেজি আকারভেদে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। যদিও সরকার নির্ধারিত দর ৩৫ টাকা। এ দামে কোথাও আলু বিক্রি করতে দেখা যায়নি। বাজারে এখন চার ধরনের পেঁয়াজ দেখা যায়। সবচেয়ে দাম কম চীনা ও তুরস্কের পেঁয়াজের, মানভেদে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। পাকিস্তানি পেঁয়াজ ৬০ টাকার আশপাশে ও দেশি পেঁয়াজ মানভেদে কেজি ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। চীনা রসুন কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা ও দেশি রসুন ১২০ থেকে ১৪০ টাকা দরে বিক্রি করেন বিক্রেতারা। বাজারে ছোট দানার মসুর ডাল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা ও মোটা দানার মসুর ডাল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে সবজির মতো চাল ও ভোজ্যতেলের দাম কমার লক্ষণ নেই। গত বছরের তুলনায়, মোটা চালের দাম কেজি প্রতি ২৪-৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫-৪৮ টাকা, মাঝারি চাল ৪২-৪৮ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮-৫৬ টাকা এবং চিকন চালের দাম ৪৫-৫৬ টাকা থেকে বেড়ে ৫৪-৬০ টাকা হয়েছে।
সুপারিতে ২৪০ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগবালাই মুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় চলতি বছর কক্সবাজারে সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলার আট উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে চাষের বিপরীতে চলতি বছর সুপারি উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১২ হাজার মেট্রিকটন। উৎপাদিত সুপারি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে যাবার পাশাপাশি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও। বাজারদর হিসেবে চলতি বছরে উৎপাদিত সুপারি বিক্রয়ে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা আয় হওবার সম্ভাবনা দেখছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে করে সুপারি চাষি পরিবার ও ব্যবসায়ীদের মাঝে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। আর বাণিজ্যিক সুপারি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে অনেকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কক্সবাজার কার্যালয়ের উন্নয়ন শাখার উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা আশীষ কুমার দে জানান, কক্সবাজার জেলায় চলতি বছর ৩ হাজার ৫১৪ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হয়েছে। এতে টেকনাফে এক হাজার ২৬০ হেক্টর, উখিয়ায় ৯৭০ হেক্টর, কক্সবাজার সদরে ৬৭৫ হেক্টর, রামু উপজেলায় ৪০০ হেক্টর, মহেশখালীতে ১৫০ হেক্টর, চকরিয়ায় ৪০ হেক্টর, কুতুবদিয়ায় ১৩ হেক্টর ও পেকুয়ায় ৬ হেক্টর জমি সুপারি চাষের আওতায় আসে এ মৌসুমে। হিসাব মতে প্রতি হেক্টরে ৩ থেকে সাড়ে তিন টন সুপারি উৎপাদিত হয়েছে। সে অনুপাতে এবারের ফলন উঠবে প্রায় ১২ হাজার মেট্রিকটন। প্রতিপণ (৮০পিস) বা কেজি প্রতি সুপারি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এ হিসাবে এবারে সুপারি বিক্রি করে আয় হবে প্রায় ২৪০-২৫০ কোটি টাকার মতো। গত মৌসুমে সুপারি চাষের আওতায় ছিল ৩৪০০ হেক্টর জমি। কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও বাজারের সুপারি ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ কালু (৫৮) বলেন, প্রাচীনকাল থেকে কক্সবাজারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুপারি চাষ হয়ে আসছে।
বাড়িভিটার পরিত্যক্ত জমি, বাড়ির চালার কিনারা ঘেঁষা বা খেতের আটিতে সহজে সুপারি চারা রোপণ করা যায়। এভাবে চাষি পরিবারগুলো ছোট-বড় বাগান করে সুপারি উৎপাদন করতো। কিন্তু ৮০ দশকে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে বৈধ-অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণ শুকনা সুপারি এদেশে আসতো।
চোরাই পথে আসা মিয়ানমারের সুপারি এদেশের হাট-বাজার সয়লাব হতো বলে দেশীয় উৎপাদিত সুপারি কম বাজারজাত হতো আর ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হতো ছোট-বড় চাষিরা। ফলে সুপারি চাষে অনেকটাই নিরুৎসাহিত হতো স্থানীয়রা। কিন্তু ১৯৯১ সালে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা নাগরিক এদেশে আশ্রয় নেয়ার পর সে দেশ থেকে সুপারি পাচার ধীরে কমতে থাকে। এদিকে চাহিদা বাড়তে থাকে স্থানীয় সুপারির। ২০১৭ সালে আবারো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রিত হবার পর সুপারির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে বেড়েছে সুপারির দামও। ফলে পরিত্যক্ত অকৃষি জমিগুলোতে সুপারির চাষাবাদ বাড়িয়েছে গৃহস্তরা। আর চলতি বছর সুপারির ফলন অন্য বছরের চেয়ে ভালো হয়েছে।
উখিয়ার পান-সুপারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুলতান আহমদ জানান, প্রতি মৌসুমে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন হাট বাজার হতে সুপারি ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে চলে যায়। পরে ওইসব সুপারি প্রক্রিয়াজাত হয়ে রপ্তানির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। অর্থকরী ফসল পান-সুপারি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল এ দুই উপজেলার ৫ হাজারের মতো পরিবার রয়েছে। আর প্রায় প্রতিটি বসত ভিটায় চাষ হয় সুপারি। যা বিক্রি করে পরিবারের বাৎসরিক খরচের একটি মোটা অংশ যোগান এখান থেকে করছে তারা। এ বছর দুই উপজেলায় প্রায় শত কোটি টাকার সুপারি বাজারজাত হবে বলে আশা করছি আমরা।
মেরিন ড্রাইভের মনখালী এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছৈয়দ হোছাইন (৬০) বলেন, সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় সুপারির ফলন ভালো হয় দেখে অন্যদের মতো ভিটার পরিত্যক্ত জমিতে কিছু সুপারি গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন প্রতিবছর ৬-৮ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করে পরিবারের খরচ যোগানোর বাড়তি অনুষঙ্গ হচ্ছে। তবে, সমুদ্র উপকূলে ঝাউগাছ নিধন অব্যাহত থাকায় লবণের তীব্রতায় অনেক সুপারি গাছে মড়ক দেখা দিয়েছে।
উখিয়ার মরিচ্যা বাজারে দেখা যায়, পাকা সুপারিতে সয়লাব হয়ে আছে বাজার ও আশপাশের খোলা জায়গা। একাধিক ট্রাক বোঝাই সুপারি দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ জানান, শুকানোর চেয়ে চাহিদার কারণে পাকা সুপারি প্রক্রিয়াজাত হিসেবে ভিজিয়ে রাখা হচ্ছে। মাস-তিনেক পর হতে ভিজানো সুপারি আবার বাজারজাত হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ-পরিচালক মো. আবুল কাশেম বলেন, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে আমরা সবসময় সচেষ্ট রয়েছি। মৌসুমী অর্থকরী ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করতে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের তৎপরতায় সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে দুই থেকে আড়াইশ কোটি টাকার সুপারি বিক্রয় হবে বলে আশা রাখছি। সুপারি বাজারজাতে কৃষকেরা লাভবান হওয়ায় এলাকাভিত্তিক সুপারি চাষ ক্রমশ বাড়ছে, এটা আশা জাগানিয়া। এতে অকৃষি পরিত্যক্ত জমিগুলো উৎপাদনমুখী হচ্ছে। সবধরণের কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়াতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।