অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এসবই মানুষের মৌলিক অধিকার। নারী-পুরুষ কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ সে যেই হোক না কেন। সমাজে তৃতীয় লিঙ্গরা চরমভাবে লাঞ্ছিত। অথচ সুস্থ-অসুস্থ, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক, পূর্ণাঙ্গ কিংবা অপূর্ণাঙ্গ শারীরিক সমস্যাযুক্ত বা মুক্ত সব মানুষের নারী-পুরুষ অবস্থানভেদে রয়েছে সমান অধিকার। ইসলাম সবার জন্যই তাদের অধিকারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছে। শুধু তা-ই নয়, সম্পদের উত্তরাধিকারসহ ইসলামের বিধান পালনেও রয়েছে সম অধিকার।
তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায় সমাজে চরমভাবে অবহেলিত। তারা স্বাভাবিকভাবে কারো সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে পারে না। সমাজ তাদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে চায় না। অথচ তারাও আশরাফুল মাখলুকাত। অন্যসব নারী-পুরুষের মতো তাদেরও সমাজের সব সুবিধা ভোগ করার অধিকার রয়েছে। নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কিংবা যৌথ শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকলেও তৃতীয় লিঙ্গরা শিক্ষাব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সম্প্রতি তাদের ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা সহায়তা দিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি মাদ্রাসা। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। উদ্যোগটি আরও আগেই নেয়ার প্রয়োজন ছিল। শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
তারা আসলে একধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ। সৃষ্টিগতভাবে বিশেষ অঙ্গহানীর কারণে তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যে কারণে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। তাদের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ দিতে কেউই এগিয়ে আসে না। এটি তাদের প্রতি একধরনের জুলুম তথা অবিচার।
তৃতীয় লিঙ্গ কারা: ইসলামি শরিয়তে তৃতীয় লিঙ্গ বলা হয় সেসব মানুষকে, যাদের লিঙ্গ নির্ধারণে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাহলো এমন- – কারো পুরুষ লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ উভয়টিই পরিলক্ষিত হয়। – কারো কোনো লিঙ্গই পরিলক্ষিত হয় না। তবে মূত্রত্যাগের জন্য একটি ছিদ্রপথ রয়েছে। – আবার কারো কারো আলাদা আলাদা লিঙ্গ রয়েছে ঠিকই, যার আকার-আকৃতি অস্বাভাবিকভাবে ছোট। আল্লাহর সৃষ্টিতে এসব আকার-আকৃতির নারী-পুরুষরাই হলো তৃতীয় লিঙ্গ।
সৃষ্টিগতভাবে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা কানে শোনে না। কেউ কথা বলতে পারে না। কারো হাত নেই। কারো পা নেই। কারো জিহ্বা অনেক ছোট। কারো চোখ নেই। কারো জ্ঞান-বুদ্ধি নেই। তবুও তারা মানুষ। তারাও পাবে বেঁচে থাকার সব মৌলিক অধিকার।
নারী-পুরুষ হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গ নির্বাচন: ইসলামিক স্কলাররা ফিকহের পরিভাষায় তৃতীয় লিঙ্গদের নারী ও পুরুষ হিসেবে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে দেহের গঠনগত কাঠামোর দিকে নজর দিতে বলেছেন। তাহলো-
– পুরুষ তৃতীয় লিঙ্গ: যাদের উভয় লিঙ্গ আছে বা কোনো লিঙ্গ নেই। কিন্তু তাদের দাঁড়ি, গোঁফসহ বাহ্যিকভাবে পুরুষালী চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়, তারা পুরুষ তৃতীয় লিঙ্গ।
– নারী তৃতীয় লিঙ্গ: আর যেসব মানুষের লিঙ্গ আছে বা নেই কিন্তু তার বিশেষ অঙ্গ তথা স্তন কম-বেশি দৃশ্যমান হয় কিংবা ওই ব্যক্তির ঋতুস্রাব বা মাসিক হওয়ার লক্ষণ দেখা যায় বা মেয়েলী চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়, তবে বুঝতে হবে সে নারী তৃতীয় লিঙ্গ।
– যদি কারো পুরুষালী কিংবা মেয়েলী কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত না হয় কিংবা আংশিক হয় আর যদি তাদের শারীরিক গঠনে উভয় লিঙ্গ দেখা যায়। তবে তারা কোন লিঙ্গ দিয়ে মূত্রত্যাগ করে তার উপর নির্ভর করে নারী কিংবা পুরুষ চিহ্নিত করা যাবে। যদি উপরের লিঙ্গের ছিদ্র দিয়ে মূত্রত্যাগ করে তবে সে পুরুষ। আর যদি নিচের ছিদ্র দিয়ে মূত্রত্যাগ করে, তবে সে নারী তৃতীয় লিঙ্গ। আর যদি উভয় লিঙ্গ দিয়ে মূত্র বের হয়; তবে দেখতে হবে কোন পথ দিয়ে বেশি মূত্র বাহির হয়। সে অনুযায়ী লিঙ্গ ধর্তব্য হবে।
সম্পত্তিতে অধিকার: ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে তারাও মা-বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ পাবে। সম্পদের উত্তরাধিকার নির্ধারণেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। তাদের শারীরিক গঠনের উপর ভিত্তি করেই তারা পাবে সম্পদের অধিকার। পুরুষালী বা মেয়েলী চিহ্ন অনুযায়ী তারা সম্পত্তির অধিকার পাবে। এ সম্পর্কে হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ সুনানে বায়হাকিতে এসেছে-
‘যে তৃতীয় লিঙ্গ নারী বা পুরুষ প্রকৃতির সে নারী বা পুরুষের মানদ-ে উত্তরাধিকার সম্পদ পাবে। (অর্থাৎ যে তৃতীয় লিঙ্গের শারীরিক গঠন ও চিহ্ন নারীর মতো সে নারী হিসেবে অংশ পাবে আর যে তৃতীয় লিঙ্গের শারীরিক গঠন ও চিহ্ন পুরুষের মতো সে পুরুষ হিসেবে উত্তরাধিকার পাবে)। আর যে তৃতীয় লিঙ্গ নারী না কি পুরুষ এর কোনোটিই চিহ্নিত করা যায় না; সেসব তৃতীয় লিঙ্গ তার প্রস্রাবের পথের অবস্থা অনুযায়ী (নারী-পুরুষ চিহ্নিত করা সাপেক্ষে) সম্পত্তির ভাগ পাবে।’ (বায়হাকি)
তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ইসলামের বিধান: তৃতীয় লিঙ্গ হলেই নারী ও পুরুষ একসঙ্গে চলাফেরা করতে পারবে। একসঙ্গে জীবনযাপন করতে পারবে এমনটি কিন্তু নয়। ইসলাম এটি অনুমোদন করে না। বরং শারীরিক গঠনের উপর নির্ভর করেই গোটা মানবজীবনের সব বিধিবিধান ইসলামের আলোকেই পালন করতে হবে। পর্দার বিধান, পোশাকের বিধান, নামাজ-রোজার বিধানও সবার জন্য যেমন প্রযোজ্য। তাদের জন্যও তা প্রযোজ্য।
সতর্কতা: বর্তমানে অনেককেই দেখা যায়, নারীর আকৃতিতে তৃতীয় লিঙ্গ সেজে সাধারণ মানুষ থেকে অর্থ আদায়সহ ধোঁকা, প্রতারণা ও চাঁদাবাজি করে। ইসলাম এটিকে অনুমোদন দেয় না। বরং কৃত্রিমভাবে তৃতীয় লিঙ্গ সেজে এসব কাজে অংশগ্রহণ সুস্পষ্ট জুলুম বা অত্যাচার। বরং এ ব্যাপারে হাদিসের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই সব নারী-পুরুষদের উপর লানত বা অভিশাপ করেছেন; যারা (কৃত্রিমভাবে) একে অপরের সাদৃশ্য অবলম্বন করে।’ (বুখারি) সুতরাং হাদিসের আলোকে এটি প্রমাণিত যে, অর্থ আদায় বা আয়-রোজগারের জন্য কৃত্রিমভাবে তৃতীয় লিঙ্গ সাজা বা প্রতারণা করা ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহর লানত সুস্পষ্ট।
প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি সহানুভূতি ও সমাজিক মর্যাদায় সহাবস্থানের ব্যবস্থা করা অনেক উত্তম কাজ। তাদের সহযোগিতাও অনেক কল্যাণ ও সাওয়াবের কাজ। তাই তাদের অবহেলা নয়, মৌলিক মানবাধিকারের সব ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের আবশ্যক কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বিশ্বমানবতার সব তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি সহানুভূতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে অংশগ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।