হঠাৎ করে শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীতে নবজাতক ও শিশুরা ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে রোগিদের ভিড়। হাসপাতালগুলোতে আউটডোরে আগের চেয়ে প্রতিদিন প্রায় দ্বিগুন রোগী আসছে। গতকাল শনিবার (৪ জানুয়ারি) রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক নবজাতক ও শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। এসব শিশুর মধ্যে কেউ কেউ কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর অনেকে সুস্থ হয়ে উঠলেও অনেক নবজাতকের গুরুতর অবস্থাও দেখা গেছে।
হাসপাতাল থেকে দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় বহিরাগত রোগীর সংখ্যা ১৮৭ জন। এর মধ্যে নিউমোনিয়া নিয়ে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন ২৪ জন, ভর্তি হন ৫ জন। এখন পর্যন্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৩ জন। এর মধ্যে অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। তবে নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে রয়েছেন বর্তমানে ১২ জন। এদিকে গত কয়েক দিনের পারিসংখানে দেখা যায়, নিউমোনিয়া নিয়ে (৩ জানুয়ারি) ৫ জন তার আগের দিন অর্থাৎ ২ তারিখে ২ জন আর ১ তারিখে ৫ জন ভর্তি হন। এছাড়া গত জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে বহির্বিভাগে ঠান্ডা নিয়ে ৩২৩ জন, হাঁপানি নিয়ে ২৭ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিয়েছেন ১১০ জন। রংপুরের আমেনা বেগম তিন দিন আগে তার তিন মাসের নবজাতক সন্তানকে এই হাসপাতালে ভর্তি করেন। গত এক সপ্তাহ থেকে শিশুটির ঠান্ডা লাগায় শ্বাস নিতে পারছিল না। স্থানীয় চিকিৎসক দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার নিউমোনিয়া ধরা পড়ায় ঢাকায় আনা হয়েছে।
আমেনা বেগম বলেন, এক সপ্তাহ ধরে আমার সন্তানের ঠান্ডা লাগে। এরপর শুধু কান্নাকাটি করতে থাকে। রাতভর কান্না করে। কী করবো দিশেহারা হয়ে দ্রুত স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। পরে জানতে পারি ওর নিউমোনিয়া হয়েছে। স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে ওকে ঢাকায় এনে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করেছি।
পাশের বেডে লাবণী আরা নামে চার বছরের এক শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকার মিরপুরে থাকেন তারা। ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় গত দুদিন আগে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। লাবনীর মা সাহারা বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গত কয়েকদিন আগে শীত বেড়ে যাওয়ায় মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। গত তিনদিন আগে রাতে তার জ্বর আসে। এরপর জ্বর কমে আবার বাড়ছিল। তার সঙ্গে ডায়রিয়া দেখা দেওয়ায় হাসপাতালে আনলে তাকে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে কিছুটা ভালো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে ঠান্ডাজনিত কারণে রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শীতে বাতাসের আর্দ্রতা কম এবং ধূলিকণা বেড়ে যাওয়ায় ফ্লু, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। ফলে জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও শীতকালীন ডায়রিয়ায় শিশু অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
শিশুদের প্রতি বাড়তি সতর্কতার কথা জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, শিশুকে সুস্থ রাখতে শীতের কাপড় পরাতে হবে, মাথা ঢেকে রাখতে হবে, মাথায় ঠান্ডা লাগানো যাবে না, বাড়ির বাইরে অহেতুক বাচ্চাদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। শিশুর ঠান্ডা লাগলে, কাঁশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে কর্তব্যরত একাধিক চিকিৎসক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, শীত বেড়ে যাওয়ায় শিশুদের কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও ভাইরাসজনিত কারণে ডায়রিয়া দেখা দিচ্ছে। এজন্য শীতে শিশুদের বাড়তি যতœ নেওয়া প্রয়োজন। এতে তাদের নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
পরামর্শ হিসেবে হাসপাতালের নির্দেশনায় আরো বলা হয়, এসময় নবজাতক ও শিশুদের মায়ের কাছাকাছি রাখতে হবে। ঘরের মেঝে স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় রাখা যাবে না। শীতে তাদের কুসুম গরম পানি খাওয়াতে হবে। সুষম খাবারের পাশাপাশি তাদের ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে। এজন্য সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।
একই চিত্র দেখা যায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেও। সেখানেও সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি রোগির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান বলেন, শীতে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস সমস্যা দেখা দেয়। এবার ডেঙ্গুর পরেই শিশুরা শীতজনিত রোগে বেশি ভুগছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। যাদের জটিলতা বেশি, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে।
শীতের কারণে আগের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত একাধিক চিকিৎসক বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে শীতকালীন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে শীতজনিত ফ্লু ও আরএস ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, রেসেপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, অ্যাজমাজনিত পালমোনারি প্রবলেম, জ্বর ও ডায়রিয়া নিয়ে আসছেন। অনেককে অবজারভেশনের জন্য ভর্তি করা হচ্ছে। অনেকের পরিস্থিতি বুঝে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়েই বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে।