অপরাধ করার পর সংশ্লিষ্টরা নিজেদের আড়ালে রাখতে নানা পথ বেছে নেয়। প্রায়ই অপরাধীদের শনাক্ত করতে হিমশিম খেতে হয় তদন্ত সংস্থা কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তবে যথা সময়ে আলামত সংগ্রহ করে রাখলে ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড) পরীক্ষার মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী শনাক্ত সহজ হয়ে যায়। অপরাধী শনাক্ত করা ছাড়াও নিখোঁজ ব্যক্তিকে শনাক্ত করা, পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব নির্ধারণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে অনেক সময় মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এতদিন সীমিত আকারে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছিল। এই পরীক্ষা আরও বৃহত্তর পরিসরে করার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদফতর প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেজও প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। অন লাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির সংশ্লিষ্টরা জানান, নিখোঁজ ব্যক্তিকে শনাক্ত, পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব নির্ধারণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত অপরাধী শনাক্তসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলার তদন্তে সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা। যে কারণে ২০০৬ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাবরেটরির কার্যক্রম শুরু করা হয়। পরে ২০১০ সালের এপ্রিলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসের নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবনের ১১ তলায় আরেকটু বৃহত্তর পরিসরে এই ল্যাবরেটরি স্থানান্তর করা হয়।
প্রতিনিয়ত ডিএনএ পরীক্ষার গুরুত্ব বাড়তে থাকায় এই ল্যাবরেটরিকে অধিদফতরে রূপান্তরের জন্য ডিএনএ আইন পাস করে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। কিন্তু অধিদফতর গঠনের প্রক্রিয়াটি ঝুলে থাকে দীর্ঘদিন। চলতি বছরের ১২ আগস্ট ‘ডিএনএ আইন-২০১৪’ (২০১৪ সালের ১০ নম্বর আইন) এর ধারা ২০ অনুযায়ী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ নামে একটি অধিদফতর স্থাপনের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অথচ তারও প্রায় ৫ বছর আগে ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ গঠন ও অধিদফতরের জন্য ৬৪টি পদ সৃষ্টির সম্মতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একজন মহাপরিচালক (ডিজি), পরিচালক ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ৫০টি পদ সৃষ্টির এই অনুমোদন দেওয়া হয় তখন। এছাড়া অধিদফতরের আওতায় ঢাকায় তিনটি ল্যাবেরটরি ও সাতটি বিভাগীয় ল্যাবরেটরির জন্য আরও ৪২টি পদ সৃষ্টির অনুরোধ করা হয়। বর্তমানে ৬৪টি পদের অনুমোদন রয়েছে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ঘৃণ্যতম অপরাধ দমনে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির মাধ্যমে পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহায়তা দেওয়া হয়। এরইমধ্যে এই ল্যাবরেটরির কার্যক্রম সারাদেশে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভাগীয় সদরের সাতটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর ল কলেজ হাসপাতাল এবং ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসব বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, বিভাগীয় ল্যাবরেটরিগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গৃহীত মামলার নমুনা সংগ্রহ করে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে থাকে। এই ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পিতৃত্ব অথবা মাতৃত্বের প্রমাণ, বংশের ধারা প্রমাণ, বিভিন্ন দুর্যোগে ও দুর্ঘটনায় নিখোঁজ এবং মৃত ব্যক্তির পরিচিতি উদ্ধারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ হাজার ১১৪টি মামলার ২২ হাজার ৫৪৪টি নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। জানা গেছে, ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে হত্যার পর যেসব সেনা কর্মকর্তার চেহারা বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিল, সেই সেনা কর্মকর্তাদের পরিচয়ও শনাক্ত হয়েছিল এই ল্যাবরেটরিতে। এদের মধ্যে কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এলাহি মানজুর চৌধুরী, মেজর আহমেদ আজিজুল হাকিম এবং বিডিআরের ডিএডি ফসিহ উদ্দিন চৌধুরীও ছিলেন। এছাড়া ২০১২ সালে সাভারের তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকা-ে সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া ৪১টি মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের মৃতদেহগুলো শনাক্ত করা করা হয় ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে।
অধিদফতরের অফিস ভবন স্থাপনসহ বিভিন্ন বিষয়ে চলতি বছরের ২৭ আগস্ট মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অধিদফতরের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমপ্লেক্স ভবন তৈরি করার মতো জমি বরাদ্দের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি পাঠানো এবং এর অগ্রগতি মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে অস্থায়ীভাবে জাতীয় মহিলা সংস্থার ভবনে রুম বরাদ্দের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের নিয়োগ বিধি ও সাংগঠনিক কাঠামো এবং অফিস সরঞ্জামাদি অনুমোদনের জন্য অর্থ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি পাঠানো হয়।
ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় কাজগুলো গুছিয়ে নিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুল হাসান খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘অধিদফতরের জন্য ঢাকায় জমি, ভবন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কাজ চলছে। পূর্ত মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে কাজ করছে। কিছুটা হয়তো সময় লাগবে।’
‘ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ গঠন ও ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. আবুল হোসেন বলেন, ‘অধিদফতর গঠনের বিষয়টি অনেকদূর এগিয়েছে। আশা করছি শিগগিরই অধিদফতর প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ হবে।’
ডিএনএ প্রোফাইলিং কী? ল্যাবরেটরির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা জানান, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কোনও ব্যক্তি বা ভিকটিম, অভিযুক্ত কিংবা সন্দেহভাজন এবং অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত নমুনার ডিএনএ-কে তুলনা করে তাদের মধ্যে মিল বা অমিল খুঁজে বের করা হয়। প্রতিটি মানুষের ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ডিএনএ একই। পার্থক্য বা পরিববর্তনশীলতা বিদ্যমান থাকে মাইক্রোস্যাটেলাইট সিকোয়েন্স বা শর্ট টেনডেম রিপিট (এসটিআর) হিসেবে। আধুনিক ডিএনএ প্রোফাইলিং পদ্ধতি এই পরিবর্তনশীলতার একটি তুলনামুলক চিত্র তুলে আনে। যাকে সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে প্রকাশ করা হয়। যমজ সন্তান ছাড়া পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ডিএনএ প্রোফাইল অদ্বিতীয় বা ইউনিক। অর্থাৎ কারও সঙ্গে কারও মিল নেই।