ভারতে মুসলিম শুন্য করার নীলনকশার অংশ ওয়াকফ বিল। ভারতে মুসলিম সম্প্রদায় ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদদের তীব্র আপত্তির মুখেও লোকসভায় পাশ হয়েছে বিতর্কিত ওয়াকফ বিল। টানা ১২ ঘণ্টা বিতর্কের পর বুধবার গভীর রাতের ভোটাভুটিতে এর পক্ষে ভোট পড়ে ২৮৮টি এবং বিপক্ষে পড়ে ২৩২টি। এরপর রাজ্যসভায় যাবে বিলটি। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা বলছেন, এর মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে সরকারের হাতে। দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবি, এই বিলের মাধ্যমে মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও হস্তক্ষেপ করবে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। এই বিলের মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উৎখাতের প্রাথমিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে গুজরাটের কসাইখ্যাত মোদি সরকার। এদিকে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া জোট’ সংশোধিত বিলটিকে ‘অসাংবিধানিক’ এবং ‘অপদখল’ বলে আখ্যা দিয়েছে। কংগ্রেস বলেছে, সরকার সংখ্যালঘুদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে।
স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়মের অধীনে ওয়াকফ বোর্ডের কমিটিতে দুই জন হিন্দুত্ববাদীকে রাখতে হবে। যা পুরোপুরিভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং দেশটিতে মুসলিমদের দমিয়ে রাখার দৃশ্যমান প্রভাব। একটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন অনুষ্ঠান বা সম্পত্তি বিষয়ক কার্যক্রমে মুসলিম সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা যেমন সমীচীন নয় তেমন ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হিসেবে সরকারের হস্তক্ষেপ এবং হিন্দু সদস্য অন্তর্ভুক্তকরণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা স্পষ্টতই দেশটিতে মুসলিম ধর্মকে পালনে এবং ইসলামের প্রতি মোদি সরকারের ঘৃনাত্মক মনোভাব প্রকাশ করেছে। এমনকি কসাই মোদির এমন পদক্ষেপকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমেরিকা। বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত কর্মকা-ের কারনে আমেরিকান সিক্রেট সংস্থা সিআইয়ে দেশটির ঘৃণ্যতম সংস্থা ‘র’ কে কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কথা বলে এসেছে।
যদিও এ প্রসঙ্গে দেশটির সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী এবং কসাই মোদির দালাল কিরেন রিজিজু বলেন, দেশের ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। এই সম্পত্তি সঠিকভাবে পরিচালিত হলে শুধু মুসলিমদের জীবনই নয়, দেশও বদলে যাবে।’ তবে তার কথার এটা বুঝতে বাকি নেই যে, এতে করে মুসলিমদের সম্পত্তি দখলের যে পায়তারা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
উল্লেখ্য, মুসলিমদের কল্যাণে দান করা জমিকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলা হয়। যা বিক্রি বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় না। ভারতে রেল ও সেনাবাহিনীর পরই সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি রয়েছে ওয়াকফার আওতায়। অন্তত ১০ লাখ একর ওয়াকফ ভূমি রয়েছে। যার কারণেই বিজেপির লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে মুসলিমদের এই সম্পত্তিতে। এ ভূমি পরিচালনায় প্রতি রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে রয়েছে ওয়াকফ কাউন্সিল। সংশোধিত বিল অনুযায়ী, এই কাউন্সিল ও বোর্ডে মুসলমান নন এমন দুজন সদস্য থাকতে হবে। এছাড়া সম্পত্তি প্রদানের প্রাথমিক শর্ত হলো-অন্তত পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হতে হবে। তা না হলে ওয়াকফাকে সম্পত্তি দেওয়া যাবে না। এর মাধ্যমে মুসলিমদের সম্পত্তি দানেও পদ্ধতিগতভাবে এক প্রকার নিষেধাজ্ঞা দিলো হিন্দুত্ববাদী দলটি। গত বুধবার লোকসভায় বিলটি পেশ করেন সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। এর আগে সরকারের অবস্থানের কথা ব্যাখ্যা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এই ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ১৯৯৫-এর ওয়াকফ সম্পত্তিসংক্রান্ত আইন সংশোধন করবে। ২০১৩-তেও এই আইনের সংশোধন হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় বিনা বিতর্কে সর্বসম্মতিতে সেই বিল পাশ হয়েছিল। এআইএমআইএমের আসাদউদ্দিন ওয়াইসি জানান, তিনি প্রতীকী পদক্ষেপে মহাত্মা গান্ধীর অনুসরণে এই আইন ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৩-তে যখন লালকৃষ্ণ আদভানি, সুষমা স্বরাজের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে বিলের সংশোধনী পাশ হয় তখন কোনো বিতর্ক হয়নি। তার প্রশ্ন, তারা কি ভুল ছিলেন?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী দাবি করেছেন, এই বিলের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক শ্রেণিতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের ব্যক্তিগত আইন এবং সম্পত্তির অধিকারের বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসাবে বিলটিকে ব্যবহারের চেষ্টা হচ্ছে।
উদ্ভব ঠাকরের শিবসেনার সংসদ সদস্য অরবিন্দ সাওয়ন্ত ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য নিযুক্ত করার সমালোচনা করে বলেছেন, সরকার কি মন্দির কমিটিতে অ-হিন্দুদের থাকার অনুমতি দেবে? এদিকে এই বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তৃণমূল সংসদ সদস্য কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি এই বিলকে একেবারেই সমর্থন করছি না। এই বিল অসাংবিধানিক। তৃণমূলের তরফে আমরা এই বিলের বিরোধিতা করছি।’
তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, এই বিলটি সম্পত্তিসংক্রান্ত আইন সংশোধন করবে এবং এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। লোকসভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় অমিত শাহ ওয়াকফ সম্পত্তির একটি দীর্ঘ তালিকা দেখান। তিনি দাবি করেন, এতে মন্দির বা অন্যান্য ধর্মের জমিও প্রদানের খতিয়ান আছে। তিনি বলেন, আপনি অন্যায় করে কারও সম্পত্তি দান করতে পারেন না। দান একমাত্র নিজের জমিই করা যায়। অমিত শাহ আরও বলেন, একজন মুসলিম তো চ্যারিটি কমিশনার হতেই পারেন। তাকে ট্রাস্ট দেখতে হবে না, আইন অনুযায়ী ট্রাস্ট কীভাবে চলবে, সেটা দেখতে হবে। এটা ধর্মের কাজ নয়। এটা প্রশাসনিক কাজ। সব ট্রাস্টের জন্য কি আলাদা কমিশনার থাকবে? আপনারা তো দেশ ভাগ করে দিচ্ছেন। আমি মুসলিম ভাইবোনদের স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আপনাদের ওয়াকফ বোর্ডে কোনো অমুসলিম থাকবে না।