শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩২ পূর্বাহ্ন

মার্কিন নির্বাচনে জালিয়াতির পাঁচ অভিযোগ কতটা সত্য?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
  • আপডেট সময় রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (যিনি গত ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে হেরে গেছেন) এবং তার নির্বাচনী দল এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এর বিরুদ্ধে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু তারা যেসব জালিয়াতির অভিযোগ তুলছেন, তার পক্ষে কি প্রমাণ আছে?
গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আইনজীবী রুডি গিলিয়ানি জালিয়াতির অনেক অভিযোগ তুলে ধরেন। ট্রাম্পও প্রথম থেকেই (বস্তুত নির্বাচনের আগে থেকেই) নির্বাচনে জালিয়াতির নানা অভিযোগ তুলেছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির রিয়েলিটি চেক টিম জালিয়াতি এবং অনিয়মের প্রধান অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখেছে।
অভিযোগ ১: ডেমোক্র্যাটদের ব্যাখ্যাহীন ভোটের জোয়ার
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং অন্যান্যরা বেশ কয়েকটি অভিযোগ তুলেছেন যে, ভোট গণনার সময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের পক্ষে হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যায় ভোট আসতে শুরু করে।
গত ১৯ নভেম্বরের এক সংবাদ সম্মেলন রুডি গিলিয়ানি একই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে বলেন যে, ডেট্রয়েটের এক ভোট গণনা কেন্দ্রে একদিন সকালে হাজার হাজার অতিরিক্ত ব্যালট এসে হাজির হয়। সেখানকার একজন ভোট কর্মীর দাবির ভিত্তিতে গিলিয়ানি এই অভিযোগ তোলেন।
ওই ভোট কর্মীর দাবি, তিনি সেখানে দুটি ভ্যান আসতে দেখেন, যেগুলোতে খাবার আনার কথা থাকলেও ভ্যান দুটি থেকে তিনি ‘কোন খাবার নামাতে দেখেননি। অথচ কাকতালীয়ভাবে তখন গুঞ্জন ওঠে মিশিগানে আরও এক লাখ বেশি ব্যালট খুঁজে পাওয়া গেছে। সবশেষ ভ্যানটি সেখান থেকে চলে যাওয়ার দুঘণ্টা পার হয়নি তখনো।’
কিন্তু এই অভিযোগটিসহ অন্য আরও কিছু অভিযোগ ১৩ নভেম্বর একজন বিচারক তার রায়ে বাতিল করে দেন এই বলে যে, এগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। রিপাবলিকানদের তরফ থেকে এরকম আরও অভিযোগ তোলা হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাজ্যে, যেখানে দুই প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল।
তাদের অভিযোগ ছিল, এসব রাজ্যে হঠাৎ করে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোটের জোয়ার দেখা গেছে; যা নির্বাচনে জালিয়াতি পরোক্ষ ইঙ্গিতবহ অভিযোগ। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, এ জন্য দায়ী ছিল প্রকৃতপক্ষে কাগজপত্রের ভুল বা সফটওয়্যারের ত্রুটি, যা ধরা পড়ার পর সংশোধন করা হয়েছিল।
এখানে আরও একটি বিষয় বলা দরকার। এবারের নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। আর এদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ডেমোক্র্যাট সমর্থক। এসব ভোট গণনায় সময় লেগেছে বেশি আর নির্বাচনের পরদিন এসব ব্যালট এক করে ফল প্রকাশ করা হচ্ছিল ধাপে ধাপে।
ফলে হঠাৎ করেই জো বাইডেনের পক্ষে ভোট হঠাৎ উর্ধ্বমুখী হয়েছিল। আর এটা সত্যি নয় যে, এসব অতিরিক্ত ভোটের সবই জো বাইডেন পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরও অনেক ভোট ছিল।
অভিযোগ ২: ভোট গণনার সময় সেখানে যেতে দেয়া হয়নি
ট্রাম্প এবং তার আইনজীবীরা অন্য অভিযোগ তুলেছিলেন যে, ফিলাডেলফিয়া এবং ডেট্রয়েটের মতো কিছু ডেমোক্র্যাটশাসিত নগরীতে ভোট গণনার স্থানে রিপাবলিকান ভোট পর্যবেক্ষকদের প্রবেশাধিকার ছিল না।
ভোট কেন্দ্রে ব্যালট গণনার সময় সেখানে ভোট পর্যবেক্ষকদের ঢুকতে দেয়া হয়, যাতে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। বেশিরভাগ রাজ্যেই পর্যবেক্ষকদের এই সুযোগ দেয়া হয়, যদি কিনা তারা নির্বাচনের আগের দিন নিবন্ধন করেন। আর ভোট পর্যবেক্ষকরা সাধারণত কোন একটি দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
কিছু এলাকায় ভোট পর্যবেক্ষকদের সংখ্যা সীমিত রাখা হয়েছিল। এর কারণ ছিল মূলত করোনাভাইরাস। কিন্তু ডেট্রয়েট এবং ফিলাডেলফিয়াতে দুটি দলের পর্যবেক্ষকদেরই ভোট গণনা পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
ডেট্রয়েটে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানÍ এই দুটি দলের ১৩০ জনের বেশি পর্যবেক্ষককে ভোট গণনার স্থানে যেতে দেয়া হয়েছিল। পেনসিলভানিয়ায় এই অভিযোগটি রাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৭ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, পোস্টাল ভোট গণনার সময় পর্যবেক্ষকরা কতটা কাছাকাছি গিয়ে তা দেখতে পারবেন, সেটার সীমা বেঁধে দিয়ে পেনসিলভানিয়া রাজ্যের কর্মকর্তারা কোন আইন ভঙ্গ করেননি।
অভিযোগ ৩: ট্রাম্পের পক্ষে দেয়া ভোট বাইডেনের পক্ষে গোণা হয়েছে
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করা একটি অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে তার লিগ্যাল টিম । এই অভিযোগে বলা হচ্ছে যে, জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে এ রকম কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের ভোট গণনা ব্যবস্থায় সমস্যা ছিল। এসব রাজ্যে ট্রাম্পের পক্ষে পড়েছে এমন লাখ লাখ ভোট তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের পক্ষে গণনা করা হয়েছে।
এই অভিযোগের প্রমাণ নেই এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের লিগ্যাল টিম এর পক্ষে কোন প্রমাণ হাজিরও করেননি।
মূলত একটি রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যম ‘ওয়ান আমেরিকান নিউজ নেটওয়ার্ক (ওএএনএন)’ ভোট গণনার মেশিন ‘ডোমিনিয়ন ভোটিং মেশিনের’ ব্যাপারে এই অভিযোগ করেছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই অভিযোগেরই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র ভোট গণনায় এই মেশিনটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
ওয়ান আমেরিকান নিউজ নেটওয়ার্কের সংবাদ প্রতিবেদনে এই অভিযোগটি করা হয়েছিল ‘এডিসন রিসার্চ’ নামক একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক গোষ্ঠীর উদ্ধৃতি দিয়ে। এডিসন রিসার্চ নাকি ‘অযাচাই-কৃত তথ্য’ বিশ্লেষণ করে দেখতে পেয়েছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে পড়া লাখ লাখ ভোট এভাবে উল্টে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এডিসন রিসার্চের প্রেসিডেন্ট ল্যারি রসিন বলেছেন, এ রকম কোন রিপোর্ট তারা তৈরিই করেননি। আর কোন ভোট জালিয়াতির প্রমাণও তাদের কাছে নেই।
ডোমিনিয়ন ভোটিং সিস্টেমও একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘ডোমিনিয়ন মেশিনে ভোট পাল্টে দেয়া হয়েছে বা ভোট মুছে ফেলা হয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা শতভাগ মিথ্যা।
অভিযোগ ৪: ভোটিং মেশিনগুলোর মালিকানা ডেমোক্র্যাটদের হাতে
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও অভিযোগ করেছিলেন যে, ডোমিনিয়ন ভোটিং সিস্টেমের মালিকানা কট্টর বামপন্থীদের হাতে। ট্রাম্পের লিগ্যাল টিমও ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, এই কোম্পানির সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ও তার স্ত্রী সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এবং অন্যান্য ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতিকের সম্পর্ক আছে।
কিন্তু এক বিবৃতিতে ডোমিনিয়ন ভোটিং সিস্টেম জানিয়েছে, এটি একটি দলনিরপেক্ষ মার্কিন কোম্পানি। তাদের মালিকানার সঙ্গে ক্লিনটনদের বা ন্যান্সি পেলোসি বা অন্য কোন শীর্ষ ডেমোক্র্যাটিক নেতার কোন সম্পর্ক নেই।
তবে এখানে একটা পার্থক্য মনে করিয়ে দেয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডোমিনিয়নের সরাসরি মালিকানার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে অভিযোগ করেছেন, তার সঙ্গে এই কোম্পানি বিভিন্ন দাতব্য কাজে বা লবি করার জন্য যে অর্থ খরচ করেছে, তার পার্থক্য আছে।
রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক এই উভয় দলকেই ডোমিনিয়ন চাঁদা দিয়েছে। তবে তাদের মতো একটি কোম্পানি সরকারি ব্যবসা পাওয়ার জন্য এরকম লবি করা যুক্তরাষ্ট্রে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
২০১৪ সালে ডোমিনিয়ন ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের তহবিলে চাঁদা দেয়। কিন্তু এই কোম্পানি আবার সিনেটে রিপাবলিকান দলের নেতা মিচ ম্যাককোনেলের জন্যও চাঁদা দিয়েছে।
পেলোসির ব্যাপারে যে গুজব শোনা যায়, তা মূলত তার সাবেক চীফ অব স্টাফ নাদিম এলশামি ডোমিনিয়নে যোগ দেয়ায়। কিন্তু ডোমিনিয়ন এর আগে রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে যুক্ত লোকজনকেও চাকুরিতে নিয়েছে।
অভিযোগ ৫: হাজার হাজার মৃত মানুষ ভোট দিয়েছে
ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের অভিযোগ, এবারের নির্বাচনে হাজার হাজার মৃত মানুষের পক্ষে ব্যাপক সংখ্যায় ভোট দেয়া হয়েছে। জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে এ রকম রাজ্যগুলোতে এভাবে হাজার হাজার ভোট পড়েছে।
বিবিসির রিয়েলিটি চেক টিম মিশিগানে এ রকম দশ হাজার মানুষের একটি তালিকা যাচাই করে দেখেছে। এই তালিকার সবাই মৃত হলেও তাদের নামে ভোট দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই তালিকায় আসলে মৌলিক ত্রুটি আছে।
অন্যান্য মৃত ভোটের তালিকা যাচাইয়ের পর সেখানেও একই জিনিস দেখা গেছে। এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে মৃত লোকদের নামে ব্যালট পেপার নিয়ে ব্যাপক হারে ভোট জালিয়াতি করা হয়েছে। ফক্স নিউজের একজন উপস্থাপক টাকার কার্লসন একবার ট্রাম্পের নির্বাচনী টিমের করা এ রকম একটি অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি এর জন্য ক্ষমাও চান। ট্রাম্পের নির্বাচনী টিম জর্জিয়ায় মাত্র একজন ‘মৃত ভোটারের’ কথা উল্লেখ করেছিল, কিন্তু পরে দেখা গেল সেই লোকও আসলে জীবিত। মার্কিন নির্বাচনে অতীতেও ঘটা ঘটনায় মনে হয়েছে যে, কোন মৃত লোক বুঝি ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এ রকম ঘটনা যে ব্যাপকভাবে ঘটেছে তার প্রমাণ নেই। মূলত কাগজপত্রের ভুলে এ রকম হয়ে থাকে। ভোটটি হয়তোবা বৈধ। অথবা হয়তো একই পরিবারের একই নামের আরেকজন সদস্য তার ব্যালটে এই ভোট দিয়েছেন। সূত্র : বিবিসি বাংলা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com