বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৫ পূর্বাহ্ন

তারা ধানক্ষেতের অদৃশ্য প্রহরী

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

প্রচণ্ড রোদে ধানক্ষেতের পাতাগুলো যেন ঝলসে ওঠে এক আশ্চর্য আলোয়। হালকা হাওয়া বয়ে যায়, পাতার ভেতর লুকিয়ে থাকা এক অজানা জীবনের গল্প কানে আসে পাতার সুরে। তখনই শোনা যায় একটানা কিচিরমিচির। কেউ যেন অলক্ষ্যে চেয়ে আছে, নজর রাখছে চারপাশে। হঠাৎই ধরা দেয় সে। তার একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ, হলুদ ঠোঁট, গা ছমছমে গম্ভীর রঙের পালক; ধানক্ষেতের সেই রহস্যময় পাখি শালিক।
পাখিটি শুধু পাখি নয়, ধানক্ষেতের এক অদৃশ্য প্রহরী। সে মাঠের ওপর দিয়ে উড়ে যায়, ক্ষেতে নামার আগে চারদিক দেখে। পাতার আড়ালে লুকানো মাজরা পোকা, ধান চুষে নেওয়া লেদা পোকা, ফড়িং বা ঘাসফড়িং সবই যেন তার শিকারের তালিকায়। কৃষকের জীবনে যখন কীটনাশকের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে; তখন শালিকের মতো প্রাকৃতিক বন্ধু নিঃশব্দে কাজ করে চলে মাঠে মাঠে।
শালিকেরা দলবেঁধে আসে, দলবেঁধে যায়। দিনের বিভিন্ন সময়ে ধানক্ষেতের এক প্রান্তে বসে থাকে, আবার কখনো শীষের মাথায় উঠে বসে। কৃষকেরাও বলেন, ‘যেখানে শালিক আছে; সেখানে পোকামাকড় বেশি ক্ষতি করতে পারে না।’ তাই পাখিটিকে অনেকেই কৃষকের প্রকৃত বন্ধু মনে করেন। তাদের উপস্থিতি যেমন উপকারী; তেমনই মাঠে প্রাণের সঞ্চার করে।
শালিক শুধু ক্ষেতে পোকা খায় না বরং সে প্রকৃতির এক ভারসাম্য রক্ষাকারী যোদ্ধা। মাটি থেকে শুরু করে গাছ পর্যন্ত, তার চোখে পড়ে ক্ষতিকর জীবাণুর আনাগোনা। তার ঠোঁটে ধরা পড়ে সেইসব পোকা; যারা চুপিসারে ফসলের ক্ষতি করে।
শহরের ধুলাবালিতে তার চলাফেরা কিছুটা কমলেও গ্রামবাংলার মাঠে এখনো শালিকেরা সক্রিয়। তারা গাছের ডালে বসে, মাঠে নেমে আসে, আবার হঠাৎ উড়ে যায় বিশাল আকাশে। ছোট্ট ছেলেমেয়েরা তাদের দেখে খুশি হয়, কেউ কেউ তালি দেয়, কেউ ছুঁড়ে মারে ঢিল। তবুও শালিক আসে ধৈর্য নিয়ে, নীরব ভালোবাসা নিয়ে।
বিকেলের রোদ যখন একটু কমে আসে; তখন ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে একঝাঁক শালিক উড়ে যায়। তাদের ডানার শব্দ আর কণ্ঠের ছন্দে যেন পরিবেশ জেগে ওঠে। মাঠের পাশে বসে থাকা কৃষক তখন খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। তারা হয়তো বলেন, প্রাকৃতিক পাহারাদার এসে গেছে তাদের ক্ষেত পাহারা দিতে।
শালিককে অনেকেই সাধারণ পাখি ভাবেন। কিন্তু সে কেবল পাখি নয়। সে বাংলার ধানের গল্পে এক নীরব চরিত্র। যে নায়কের মতো কোনো কৃতিত্ব দাবি করে না। তবুও দিনের পর দিন নিজের ভূমিকা পালন করে যায়। তার ডানায় ভর করেই অনেক সময় টিকে থাকে ফসল আর কৃষকের মুখে ফোটে হাসি।
শালিকই আমাদের শেখায় প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে, তুচ্ছ মনে হলেও প্রতিটি প্রাণ কীভাবে জীবনের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, নিরীহ প্রাণীটি আজ কিছুটা বিপর্যস্ত। পরিবেশদূষণ, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, নগরায়ন আর গাছপালার অভাবে দিন দিন কমে যাচ্ছে শালিকের সংখ্যা। আগের মতো আর তেমন দেখা যায় না দলবেঁধে উড়ে যাওয়া চেনা পাখিগুলোকে। একসময়ের মাঠ কাঁপানো কিচিরমিচির শব্দ এখন অনেকটাই ম্লান।
অথচ শালিক না থাকলে এর প্রভাব শুধু পাখির জগতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তারা যেসব পোকামাকড় খেয়ে ফেলে, সেগুলো অবারিত হারে বেড়ে ফসলের ওপর আক্রমণ চালায়। ধান গাছের গোড়ায় মাজরা পোকা, পাতার রস চুষে নেওয়া লেদা বা গলগ্রন্থি পোকারা সহজেই বিস্তার লাভ করে। ফসলের পরিমাণ কমে যায়, কৃষক আর দেশের খাদ্য উৎপাদনে দেখা দেয় সংকট। একেকটা পাখির অনুপস্থিতি মানে পুরো খাদ্যচক্রে এক অদৃশ্য ঘাটতি, যার খেসারত দিতে হয় মানুষকেই।
তবুও যতদিন মাঠে ধান গজাবে, পাতার ফাঁকে লুকোবে পোকামাকড়; ততদিন শালিকের প্রয়োজন ফুরাবে না। তাকে বাঁচাতে হলে আমাদেরই ভাবতে হবে। প্রকৃতিকে ভালোবাসার অর্থ শুধু বৃক্ষরোপণ নয় বরং যারা নীরবে তার ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে, তাদের জন্যও নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com