কক্সবাজারের পাহাড় সমৃদ্ধ মহেশখালী দ্বীপের বুক চিড়ে তিন ইউনিয়ন নদীর পূর্ব পার্শ্বে কালারমারছড়া এবং নদীর পশ্চিম পার্শ্বে মাতারবাড়ী-ধলঘাটা ইউনিয়ন মধ্যখানে প্রবহমান ৮০ দশকের কোহেলিয়া নদীটি। সম্প্রতি উপজেলার মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য মাতারবাড়ীর দক্ষিণে ১ হাজার ৪১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমানে সেখানে মাটি ভরাট করে প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে। সেই উন্নয়ন কাজের বিভিন্ন বর্জ্য ও পলি মাটি পাইপের মাধ্যমে সরাসরি কোহেলিয়া নদীতে ফেলায় দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে জীবিত এ আদিকালের নদীটি কিন্তু এখন প্রায় মৃত! যার দরূন প্রাচীনতম নদীতে ইঞ্জিনচালিত লবণের বোট ও বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এদিকে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পলি মাটি নদীর পানির সঙ্গে মিশে বর্তমানে নদীর পানি ঘোলাটে এবং দূষিত হয়ে জনজীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। নদী থেকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় আশেপাশের প্রায় অর্ধশত চিংড়ি প্রজেক্টের মাছও মারা গেছে। এ কারণে চলতি চিংড়ি প্রজেক্টের ইজারাদারদের কয়েকশ’ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বলে জানান তারা। দিন দিন নদীটি নাব্যতা হারিয়ে জেলেরা মৎস্য শিকার, কাঁকড়া আহরণকারীরা কাঁকড়া শিকার করতে পারছেনা। এ পুরানো যুগের নদীর ওপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল ছিল উপজেলার কয়েক হাজার জেলেসহ কেটে খাওয়া পরিবার। কিন্তু এ নদী দিন দিন ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় জেলেদের জালে সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা যাচ্ছে না। সামুদ্রিক মাছের প্রচুর পুষ্টিগুণ ও নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা থাকলেও নদী ভরাটের কারণে দিনদিন এমন পুষ্টিকর সুস্বাদু মাছ থেকে বঞ্চিত এতদাঞ্চলসহ জেলার বাইরের অধিকাংশ মানুষ। জীবিত নদীটি মৃত হওয়ার আশংকায় ক্ষতিগ্রস্ত ও কর্মহীন হয়ে পড়ার মধ্যে বিশেষ করে উপজেলার আরেক বিচ্ছিন্ন ছোট্ট দ্বীপে মাতারবাড়ী-ধলঘাটা দু’ইউনিয়নের প্রায় ১১ শত পরিবার নদী ভরাটের প্রকোপে এখন নিঃস্ব। তাদের দিনাতিপাত খুবই দুঃখ এবং দূর্দশায় কাটছে বলে জানাগেছে। মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ কাজের সুবাদে সেখানে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে কোহেলিয়া নদীতে জেলেদের মাছ ধরাও নিষেধ করে দিয়েছে প্রকল্প নির্মাণ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ জেলেদের। তাই একমাত্র পেশা হারিয়ে এ নদী নির্ভরশীল ছৈয়দ আহমদের পুত্র আব্দুল খালেক, টুনু মিয়ার পুত্র মোহাম্মদ বাহাদুর ও আবু ছৈয়দের পুত্র দেলোয়ার হোছেনসহ জেলেরা। তেমনিভাবে কাকঁড়া আহরণকারীরাও হারিয়েছে। তারপরও বুকভরা আশা নিয়ে তারা স্বপ্ন দেখেন তাদের একমাত্র আয়ের উৎস নদীটি সংস্কার করে পূর্বের ন্যায় বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আহরণ করতে পারবে। এমন প্রত্যেশা করেন কোহেলিয়া নদীর পশ্চিম কূলে বসবাসকারী টুঙ্গিপাড়া খ্যাত মাতারবাড়ী আওয়ামীলীগ নেতা দিল মোহাম্মদ দিলুও জেলেদের দুঃখ, দুর্দশার কথা চিন্তা ভাবনা বরে অতিশীঘ্রই আদি যুগের নদীটি সংস্কারে দাবী তুলেন। অন্যদিকে এ নদীর ওপর দিয়ে চলাচলকারী ইঞ্জিনচালিত নৌযানও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নদী ভরাটের কারণে ভাটার সময় ছাড়াও পূর্ণ জোয়ারেও এখন বড় ও মাঝারি লবণ বোট চলাচল করতে পারছে না। আগে এ নদীতে পাঁচ/ছয় হাজার মণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন লবণ বুঝাই বড় বোট চলাচল করলেও এখন মাঝারি আকারের কোনো ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল করতে পারছে না। এদিকে নদীতে জেগে ওঠা চরগুলো একের পর এক দখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা। তারা প্রথমে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের তৈরি করে নদীর চর দখল করছে। ফলে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে কোহেলিয়া নদী। হোয়ানকের লবণ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোছাইন বলেন, কোহেলিয়া নদীটি যেভাবে দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হয় ভবিষ্যতে এ নদীর অস্তিত্ব থাকবে না। আগে এ নদী দিয়ে বড় বড় লবণ বোট চলাচল করলেও এখন ছোট ছোট লবণের বোটও চলাচল করতে পারছে না। এ কারণে লবণ নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাত দূরের কথা! লবণ মাঠ থেকে লবণ লোড করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকার এ গুরুত্বপূর্ণ নদীটি ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা না করলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন লবণচাষি ও ব্যবসায়ীরা। সাংবাদিক মাহবুব রোকন বলেন, কোহেলিয়া ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে নদীর দু’পাড়ের চিংড়ি প্রজেক্ট ও লবণ চাষে। শিগগিরই এ নদী ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা না করলে শত শত চিংড়ি প্রজেক্ট ও চাষিদের লবণ মাঠে পানি নিস্কশন বাধাগ্রস্ত হবে। এতে একদিকে যেমন দেশে লবণ ঘাটতি দেখা দেবে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন চিংড়ি ও কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক পরিবেশবিদ শরীফ জামিল বলেন, এখানকার জেলে, লবণচাষি ও ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। কাজেই প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষায় কোহেলিয়া নদী বাঁচাতে হবে। এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলা কর্মকর্তা সাইফুল আশরাফ বলেন, মহেশখালীতে কোহেলিয়া নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে- এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। এ ধরনের কিছু হয়ে থাকলে নদী ভরাট এবং দখলদারের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।